বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার জীবন ও সংগ্রাম এক অনন্য মাইলফলক। ১৯শ শতকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম অধিকার রক্ষার আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহ। পিতার মৃত্যুর পর ফারায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন দুদু মিয়া এবং তার নেতৃত্বে এই আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। জমিদারদের অত্যাচার থেকে মুসলিম কৃষকদের রক্ষা এবং সামাজিক-ধর্মীয় অধিকার আদায়ের জন্য তার সংগ্রাম ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা
মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া ১৮১৯ সালে মাদারীপুর জেলার মুলতগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শরীয়তুল্লাহ ফারায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা এবং ধর্মীয় পুনর্জাগরণের নেতা হিসেবে প্রভাবশালী ছিলেন। শৈশব থেকেই দুদু মিয়া তার পিতার থেকে ইসলামী আদর্শের শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ফারায়েজী মতবাদ সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন।
মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য পিতার নির্দেশে মক্কায় যান। এই শিক্ষার জন্য পবিত্র মক্কা সফরের সময় কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী হাজী নেছার উদ্দিন তিতুমীরের সাথে পরিচিত হন। তিতুমীরের সান্নিধ্যে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদের ইসলামী আদর্শ এবং স্বাধীনতা চেতনা সম্পর্কে অবগত হন, যা তার ভবিষ্যতের সংগ্রামী জীবনে দারুণ প্রভাব ফেলে। মক্কায় অবস্থানকালে ইসলামিক শিক্ষার গভীরতার পাশাপাশি স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের ধারণা তার মধ্যে রোপিত হয়।
কর্মজীবন ও ফারায়েজী আন্দোলনে অবদান
১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর দুদু মিয়া ফারায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তার হাতে এ আন্দোলন নতুন রূপ ও শক্তি লাভ করে। ফারায়েজী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের সাথে সম্পর্কিত জমিদারদের অত্যাচার থেকে মুসলমান কৃষকদের রক্ষা করা। জমিদাররা মুসলিম প্রজাদের উপর চরম নির্যাতন চালাতো এবং কর আদায় করতো, এর প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
দুদু মিয়া এই সময়ে মুসলিম কৃষকদের অধিকার রক্ষায় একটি লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি জনগণকে জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন এবং ব্রিটিশ শাসনের মদদপুষ্ট জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তার নেতৃত্বে সাধারণ জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক বিশাল শক্তি গড়ে ওঠে।
কানাইপুর ও ফরিদপুরে যুদ্ধে বিজয়
দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফারায়েজী আন্দোলন ব্রিটিশ শাসন ও জমিদারদের বিরোধিতায় এক উল্লেখযোগ্য শক্তি হয়ে ওঠে। ১৮৪১ সালে কানাইপুরের জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রথম অভিযান চালান। তার নেতৃত্বে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ভয়ে জমিদার সন্ধি করতে বাধ্য হন এবং ফারায়েজীদের ওপর অত্যাচার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেন।
পরের বছর ১৮৪২ সালে ফরিদপুরের জমিদার মদন ঘোষের বিরুদ্ধে দুদু মিয়া অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযানে তার নেতৃত্বে ফারায়েজীরা জমিদার বাড়ি আক্রমণ করে এবং মদন ঘোষকে হত্যা করে। ব্রিটিশ সরকার এর প্রতিশোধ নিতে ১১৭ জন ফারায়েজী কর্মীকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে ২২ জনকে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তবে দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
জনপ্রিয়তা ও আন্দোলনের বিস্তার
ফারায়েজী আন্দোলনের সফল অভিযানের ফলে দুদু মিয়ার জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অত্যাচারিত কৃষক ও মুসলমান সমাজের মানুষ তাকে ত্রাণকর্তা রূপে ভাবতে শুরু করে। আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের মনের ভয় দূর করে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার সাহস সঞ্চারিত করেন। ক্রমশ আরও মুসলিম প্রজা ও কৃষক এই আন্দোলনের প্রতি আস্থা রেখে যোগ দিতে থাকেন।
ব্রিটিশ সরকার, নীলকর ও জমিদাররা তাকে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করে এবং তাকে দমন করার জন্য একাধিক অভিযান পরিচালনা করে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়, তবে প্রতিবারই তিনি বিচারে মুক্তি পান। জমিদাররা তাকে আতঙ্কের প্রতীক হিসেবে দেখতে শুরু করে। তার দৃঢ়তায় ফারায়েজী আন্দোলন দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
সিপাহি বিদ্রোহ এবং ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে ভূমিকা
১৮৫৭ সালে ভারতের সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হলে ব্রিটিশ শাসকরা দুদু মিয়াকে বিপজ্জনক মনে করে এবং তাকে গ্রেপ্তার করে। দুই বছর ধরে তাকে কলকাতার জেলে আটক রাখা হয়। ব্রিটিশরা ভয় করত যে দুদু মিয়া মুক্ত থাকলে এই বিদ্রোহের সাথে তিনি যুক্ত হতে পারেন এবং আরও বড় ধরনের বিরোধিতা গড়ে তুলতে পারেন। সিপাহি বিদ্রোহ দমন করার পর ব্রিটিশ শাসকরা তাকে মুক্তি দেয়।
কিন্তু দেশে ফিরে আসার পরেও তাকে বারবার গ্রেপ্তার করা হয়। তার দৃঢ়সংকল্প ও অদম্য মনোভাবের কারণে ব্রিটিশরা তাকে দমাতে ব্যর্থ হয়। ১৮৬০ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ঢাকার বংশালে বসবাস শুরু করেন এবং এখান থেকেই পুনরায় ফারায়েজী আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন। তার নেতৃত্বে আন্দোলন ধীরে ধীরে আরও সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
১৮৬২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার বংশালে দুদু মিয়া মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পরও তার আদর্শ ও ফারায়েজী আন্দোলনের প্রভাব অমলিন থাকে। তার তিন পুত্র—গিয়াস উদ্দীন হায়দার, আব্দুল গাফুর ওরফে নয়া মিয়া এবং সাঈদ উদ্দীন আহমদ—এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান।
ফারায়েজী আন্দোলনের প্রভাব প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা রাখে। মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার জীবন ও সংগ্রাম ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে। তার আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। তার এই অবদান আজও ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।