LC (Letter of Credit) হলো একটি আর্থিক চুক্তি, যা ব্যাংক ইস্যু করে। এটি আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারকের মধ্যে লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এটি একটি ঝুঁকিমুক্ত মাধ্যম, যা উভয় পক্ষের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
LC তে শরীয়া ইস্যু বিশ্লেষণ:
রপ্তানিকারকের পক্ষ থেকে LC এর প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস প্রাপ্তির পর ব্যাংক রপ্তানিকারকের বিল পরিশোধ করতে বাধ্য থাকে। এক্ষেত্রে আমদানিকারক কখনো Full Margin LC ওপেন করে থাকেন। কখনো Zero Margin আবার কখনো Partial Margin করে থাকেন।
- আমদানিকারক Full Margin LC ওপেন করলে তার উপর কোনো দায় (ঋণ) সৃষ্টি হয় না।
বিধান: কোনো প্রকার সুদি লোন না নেওয়ার শর্তে এটি বৈধ। এতে কোনো শরয়ী নিষেধাজ্ঞা নেই। - আমদানিকারক Partial Margin বা Zero Margin LC ওপেন করে থাকলে – এক্ষেত্রে ব্যাংক আমদানিকারকের পক্ষ থেকে বিল পরিশোধ করে থাকে এবং আমদানিকারক ব্যাংক থেকে সুদ ভিত্তিক লোন নিয়ে থাকেন।
বিধান: এটি ربا القرض এর অন্তর্ভুক্ত; শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ ও গোনাহের কাজ।
LC তে সুদের শরয়ী বিকল্প:
সুদ মানব জীবনে ক্ষতি বয়ে আনে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে সুদ নিষিদ্ধ করেছেন। প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য হলো, সুদমুক্ত জীবন গড়ে তোলা। সুদ ভিত্তিক আমদানি বাণিজ্যের বিকল্প হিসেবে নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে।
১. যথাসম্ভব Full Margin LC ওপেন করা এবং কোনো প্রকার সুদি লোন গ্রহণ না করা। – এটি যেকোনো ব্যাংকে করা যেতে পারে। তবে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে এক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া ভালো।
২. যদি Zero Margin বা Partial Margin LC ওপেন করতেই হয় তাহলে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শরণাপন্ন হওয়ার যেতে পারে। ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুদমুক্ত লেনদেনের জন্য বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। এক্ষেত্রে আদর্শিক পদ্ধতি হলো, মুদারাবা ও মুশারাকা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ গ্রহণ করা।

LC তে মুদারাবা ভিত্তিক বিনিয়োগ গ্রহণ:
Zero Margin LC এর ক্ষেত্রে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মুদারাবা ভিত্তিক বিনিয়োগ গ্রহণ করা যেতে পারে। মুদারাবা ভিত্তিক বিনিয়োগ গ্রহণের জন্য নিম্নোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে,
- গ্রাহক ব্যাংকে এলসি ওপেন করার আবেদন করবে এবং পণ্য হস্তগত হওয়ার পর ব্যাংকের সাথে মুদারাবা চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার ওয়াদা করবে।
- গ্রাহকের আবেদন ও ওয়াদার ভিত্তিতে ব্যাংক LC ওপেন করবে।
- গ্রাহক রপ্তানিকারককে পূর্ব থেকে জানিয়ে রাখবে, ব্যাংকই মূল ক্রেতা; গ্রাহক পণ্যের ক্রেতা নন।
- ব্যাংক হবে রব্বুল মাল (পুঁজিদাতা।)
- গ্রাহক হবেন মুদারিব (ব্যবসায়ী।)
- ব্যাংক রব্বুল মাল হিসেবে রপ্তানিকারকের মূল্য পরিশোধ করবে।
- পণ্য হস্তগত হওয়ার পর গ্রাহকের সাথে মুদারাবা চুক্তি করবে।
- গ্রাহক পণ্য বিক্রি করবে।
- পণ্য বিক্রির পর অর্জিত মুনাফা ব্যাংক ও গ্রাহক পূর্ব নির্ধারিত শতকরা হারে বণ্টন করে নিবে।
তবে মুদারাবা চুক্তি শুদ্ধ হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। দেশীয় সুদমুক্ত(!) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব শর্ত পালনে উদাসীনতা পরিলক্ষিত। শর্তগুলো হলো,
১. ব্যাংক গ্রাহক থেকে LC ফি গ্রহণ করতে পারবে না।
২. পণ্য জাহাজিকরণ হওয়া, shipment এর যাবতীয় ডকুমেন্ট প্রাপ্তি ও দায় গ্রহণ করার পর ব্যাংক গ্রাহকের সাথে স্বতন্ত্র মুদারাবা চুক্তি করতে পারবে; এর আগে নয়।
৩. সর্বাবস্থায় পণ্যের রিস্ক/দায় ব্যাংককেই বহন করতে হবে। গ্রাহক পণ্যের দায় বহন করবে না। অর্থাৎ পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে দায়ভার ব্যাংককেই বহন করতে হবে।
৪. এখানে দুটি চুক্তি হবে। ক. বিক্রয় চুক্তি: রপ্তানিকারকের সাথে ব্যাংকের। খ. মুদারাবা চুক্তি: ব্যাংকের সাথে আমদানিকারকের।
মুশারাকা ভিত্তিক বিনিয়োগ গ্রহণ:
Partial Margin LC এর ক্ষেত্রে ব্যাংক পার্টনারশিপ (মুশারাকা) চুক্তি করতে পারে। এক্ষেত্রে মুশারাকা পদ্ধতি হলো,
- পুঁজিতে ব্যাংক ও গ্রাহকের যৌথ অংশগ্রহণ থাকবে।
- মুনাফার আনুপাতিক হার পূর্ব থেকে নির্ধারিত থাকবে।
- বাজারে বিক্রি করে যে মুনাফা অর্জিত হবে তা পূর্বে নির্ধারিত আনুপাতিক হারে ব্যাংক ও গ্রাহক বণ্টন করে নিবে।
উল্লেখ্য, মুশারাকা চুক্তি শুদ্ধ হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। শর্তগুলো হলো,
১. LC ফি এককভাবে গ্রাহকের উপর চাপানো যাবে না।
২. ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়কে LC ফি বহন করতে হবে। তবে LC তে Title to Goods যেকোনো পক্ষের নামে হতে পারে।
৩. প্রত্যেকে নিজ পুঁজি অনুপাতে পণ্যে রিস্ক বহন করবে।
৪. ব্যাংকের অংশটি গ্রাহকের কাছে আমানত হিসেবে থাকবে। পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে এককভাবে গ্রাহকের উপর দায় চাপানো যাবে না। বরং প্রত্যেকে নিজ পুঁজি অনুপাতে দায় বহন করবে।
এভাবে মুশারাকা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
এলসি খাতে উপরিউক্ত দুটি পদ্ধতি আদর্শিক বিনিয়োগ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। এগুলো ছাড়াও ব্যাংকগুলো বৈদেশিক পণ্য আমদানিতে অন্যান্য বিনিয়োগ পদ্ধতি যেমন: M.P.I. (Murabaha Post Import), HPSM ইত্যাদি অনুসরণ করা হয়। তবে সেগুলোতে বিভিন্ন শরয়ী ইস্যু বিদ্যমান থাকে। যেমন: মুরাবাহা সাইনিং যথাসময়ে না হওয়া। ইজাব-কবুলে স্বচ্ছতার ঘাটতি, দায় গ্রহণে অস্বচ্ছলতা ইত্যাদি। কাজেই উপরিউক্ত দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করাই শ্রেষ্ঠ।
সার কথা:
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এলসি (Letter of Credit)-এর মাধ্যমে লেনদেন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সুদ ভিত্তিক লেনদেন শরীয়ায় নিষিদ্ধ হওয়ায়, আমদানিকারকদের উচিত সুদমুক্ত বিকল্প পদ্ধতি যেমন: Full Margin LC, মুদারাবা বা মুশারাকা ভিত্তিক বিনিয়োগ গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা গ্রহণ করে শরীয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব। তবে এ সব চুক্তির শর্তসমূহ যথাযথভাবে পালন করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে বিনিয়োগ কার্যক্রম শরয়ীভাবে বৈধ হয়। সুদের কুফল থেকে মুক্ত থেকে নিরাপদ ও হালাল ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় সকলের সচেতন হওয়া সময়ের দাবি। আল্লাহ সহায় হোন। আমীন।