ইসলাম ধর্মে মানুষের জীবন অমূল্য এবং এর সুরক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামিক দৃষ্টিতে মানুষ হত্যা বিনা অপরাধে একটি জঘন্যতম ও ঘৃণিত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। কাউকে অবৈধভাবে হত্যা করা শুধু সাধারণ পাপই নয়, বরং এটি কবিরা গুনাহ।
ইসলামে মানুষ হত্যার শাস্তি
ইসলামে মানুষ হত্যার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন। কুরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে কঠোর সতর্কবাণী দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমকে জেনেশুনে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, যাতে সে সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি গযব নাযিল করবেন ও তাকে লানত করবেন। আর আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন “ (সূরা নিসা: ৯৩)
এই শাস্তি প্রমাণ করে যে ইসলাম মানুষের জীবন রক্ষার প্রতি কতটা গুরুত্বারোপ করে।
যাদের হত্যা করা অধিকতর অমানবিক
মানুষ হত্যার পাপ আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, যখন তা এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঘটে, যাকে হত্যা করা সম্পূর্ণ অমানবিক এবং যার জীবন রক্ষা করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। যেমন:
- শিশু
- নিজের মাতা-পিতা
- নবী ও রাসুল
- ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী শাসক
- জ্ঞানবান আলিম বা উপদেশদাতা
এদের হত্যা করা মানবতার চরম লঙ্ঘন এবং ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ।
কুরআন ও হাদিসে মানুষ হত্যার ভয়াবহতা
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“ নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ তা‘আলার আয়াত ও নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করে, অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করে এবং মানুষদের মধ্য থেকে যারা ন্যায় ও ইনসাফের আদেশ করে তাদেরকেও। (হে নবী) তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। এদেরই আমলসমূহ ইহকাল ও পরকালে নষ্ট হয়ে যাবে এবং এদেরই জন্য তখন আর কেউ সাহায্যকারী হবে না। ” (আলে ইমরান : ২১-২২)
আল্লাহ তায়ালা মানুষ হত্যাকে এক জঘন্য অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ ধরনের অপরাধীর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছেন।
সূরা ফুরকান (৬৮-৭০) আয়াতে উল্লেখিত অপরাধ ও শাস্তি:
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আর যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোন মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে বধ করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গুনাহের (শাস্তির) সম্মুখীন হতে হবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ করা হবে এবং সে লাঞ্ছিত অবস্থায় তাতে সদা-সর্বদা থাকবে। তবে কেউ তাওবা করলে, ঈমান আনলে এবং সৎকর্ম করলে, আল্লাহ এরূপ লোকদের পাপরাশিকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেবেন। ৩২ আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (ফুরকান : ৬৮-৭০)
উল্লেখিত অপরাধগুলো:
- শিরক (আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করা):
- আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্যের উপাসনা করা ইসলাম ধর্মে সবচেয়ে বড় গুনাহ। শিরক করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায় এবং তা ক্ষমার অযোগ্য পাপ হিসেবে বিবেচিত।
- অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা:
- যাদের জীবন আল্লাহ পবিত্র করেছেন, তাদের যথার্থ কারণ ছাড়া হত্যা করা এক জঘন্য অপরাধ। যেমন, কাউকে বিনা কারণে বা অন্যায়ভাবে হত্যা করা।
- ব্যভিচার:
- ব্যভিচার ইসলামে মারাত্মক কবিরা গুনাহ। এটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ও সামাজিক জীবনকে ধ্বংস করে।
শাস্তি:
- দ্বিগুণ শাস্তি:
- কিয়ামতের দিন এই অপরাধীদের জন্য শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে। এটি বোঝায়, তাদের পাপ এত গুরুতর যে তারা শুধু শাস্তি পাবে না, বরং অন্যান্য সাধারণ অপরাধীর তুলনায় আরো বেশি কঠিন শাস্তি ভোগ করবে।
- চিরস্থায়ী লাঞ্ছনা:
- তারা জাহান্নামে চিরকাল লাঞ্ছনার শাস্তি ভোগ করবে। তাদেরকে চরম অপমানিত অবস্থায় রাখা হবে।
সূরা মায়িদাহ (৩২): অপরাধ ও শাস্তি সংক্ষেপে
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি বিধান দিয়েছিলাম, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষা করল। বস্তুত আমার রাসূলগণ তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছে, কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে বহু লোক পৃথিবীতে সীমালংঘনই করে যেতে থাকে।” (মায়িদাহ: ৩২)
অপরাধসমূহ:
- অন্যায়ভাবে হত্যা
- সীমালঙ্ঘন
শাস্তিসমূহ:
- পুরো মানবজাতি হত্যার শামিল
- সীমালঙ্ঘন করাটা মহাপাপ
হাদিসে মানুষ হত্যার ভয়াবহতা
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন:
“সর্ববৃহৎ কবিরা গুনাহ হচ্ছে চারটি:
- আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা।
- কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে হত্যা করা।
- মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া
- এবং মিথ্যা কথা বলা।”
বর্ণনাকারী বলেন: হয়তো বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মিথ্যা সাক্ষী দেয়া’’। (বুখারী ৬৮৭১; মুসলিম ৮৮)
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন:
‘‘কিয়ামতের দিন মানুষের মাঝে সর্বপ্রথম ফায়সালা করা হবে রক্তের ব্যাপারে।’’ (বুখারী ৬৫৩৩, মুসলিম ১৬৭৮; ইবনে মাজাহ ২৬৬৪)
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন:
‘‘কোন মুসলিমকে গালি দেয়া আল্লাহ’র অবাধ্যতা এবং তাকে হত্যা করা কুফুরি’’। (বুখারী ৪৮; মুসলিম ৬৪)
আল্লাহ্ তায়ালার নিকট ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীর ক্ষমার আশা খুবই ক্ষীণ
মুআবিয়া (রা.) বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)–কে বলতে শুনেছি,
“প্রত্যেক গুনাহ আশা করা যায় আল্লাহ্ তা ক্ষমা করবেন, তবে ঐ ব্যক্তির গুনাহ ব্যতীত, যে ইচ্ছা করে কোন মুসলমানকে হত্যা করে অথবা কাফির হয়ে মৃত্যুবরণ করে।” (নাসায়ী ৩৯৮৪)
আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল:
ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি? তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর সাথে কাউকে সমকক্ষ সাব্যস্ত কর, অথচ তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। লোকটি বলল, এরপর কোনটি? তিনি বললে: তারপর হল, তুমি তোমার সন্তানকে এ ভয়ে হত্যা কর যে, সে তোমার সাথে আহার করবে। লোকটি বলল, এরপর কোনটি? তিনি বললেন: তারপর হল, তুমি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে যিনা কর।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা এ কথার সত্যায়নে অবতীর্ণ করলেন: “এবং তারা আল্লাহর সঙ্গে কোন ইলাহকে ডাকে না, আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যে এগুলো করে, সে শাস্তি ভোগ করবে।“ (সূরা ফুরকান: ৬৮)।
শরীয়তসম্মত তিনটি কারণে হত্যার বৈধতা
ইসলামে মানুষের জীবন অত্যন্ত পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ। তবে শরীয়ত নির্ধারিত কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে মুসলিম শাসকের জন্য কারো উপর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“যে ব্যক্তি এ কথা সাক্ষ্য দেয় যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’; তার রক্ত প্রবাহ করা (হত্যা করা) বৈধ নয়। তবে তিনটি কারণ পাওয়া গেলে,
- প্রাণের বদলে প্রাণ (কেউ কাউকে হত্যা করলে)।
- বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচারে লিপ্ত হলে।
- ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলে এবং মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে।”
(সহীহ বুখারি: ৬৮৭৮; সহীহ মুসলিম: ১৬৭৬; আবূ দাউদ: ৪৩৫২; তিরমিজি: ১৪০২)
কাবিলের হত্যাকাণ্ড এবং তার শাস্তির ধারা
ইতিহাসের প্রথম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল আদম (আ.)-এর পুত্র কাবিলের মাধ্যমে, যিনি হিংসা ও ঈর্ষার কারণে তার ভাই হাবিলকে হত্যা করেন। এর ফলে কাবিল মানব সমাজে হত্যার সূচনা করেছিলেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“কোনো মানুষ যদি অন্যায়ভাবে হত্যা হয়, তবে তার রক্তপাতের গুনাহর একটি অংশ আদম (আঃ)-এর প্রথম সন্তান কাবিলের ওপর বর্তাবে। কারণ তিনিই মানবজাতির মধ্যে হত্যাকাণ্ড চালু করেছিলেন।”
(সহীহ বুখারি: ৩৩৩৫, ৭৩২১; সহীহ মুসলিম: ১৬৭৭)
ইসলামে হত্যার অনুমতি কেবলমাত্র শরীয়ত নির্ধারিত কারণেই দেওয়া হয়েছে। তাও আবার বিচারকের ফায়সালার ভিত্তিতে। এর বাইরে বিনা কারণে হত্যা করা মারাত্মক পাপ, যা কেবল হত্যাকারীর শাস্তির কারণই নয়, বরং এটি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। প্রথম হত্যাকারী কাবিলের অপরাধ আজও মানব ইতিহাসে অন্যায় হত্যাকাণ্ডের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই ইসলাম কঠোরভাবে অন্যায় হত্যা থেকে বিরত থাকতে এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে শিক্ষা দেয়।