নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি মানুষকে যাবতীয় পাপ এবং অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করে। হাদিসে নফসের সাথে লড়াই করাই জিহাদ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। নফস মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়, সত্যের পথ থেকে দূরে রাখতে চায়। এটিই নফসের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তবে সঠিক কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আসুন জেনে নিই নফস নিয়ন্ত্রণের ১৫টি কার্যকর কৌশল।
নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কার্যকরী কৌশলসমূহ
নফসকে নিয়ন্ত্রণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা আত্মিক প্রশান্তি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অপরিহার্য। নফস মানুষকে গোনাহের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায় এবং তাকে নৈতিক অধঃপতনের পথে পরিচালিত করে। তবে, সঠিক কৌশল এবং দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। নিচে এমন কিছু কার্যকরী কৌশল তুলে ধরা হয়েছে, যা আপনাকে নফসের প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করবে এবং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে সহায়ক হবে।
১. ফজরের পরে না ঘুমানো
ফজরের সালাতের পরে ঘুমানো পরিহার করুন। যদি অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করেন, তবে দুপুরে হালকা বিশ্রাম (কাইলুলা) নিতে পারেন।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন:
“হে আল্লাহ! তুমি আমার উম্মুতের জন্য ভোরের মধ্যে বরকত দান করো।” (জামে তিরমিযী, হাদীস নং: ১২১২)
সাহাবা (রাদি.) সাধারণত ফজরের পর আল্লাহর ইবাদত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকিরে মশগুল থাকতেন। এভাবে দিনের প্রাথমিক সময়কে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনে ব্যবহার করতেন।
২. খাবারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত অভ্যাস
দিনে সর্বোচ্চ তিনবার খাবার গ্রহণ করুন। অতিরিক্ত খাবার, বিশেষ করে ফাস্টফুড এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলুন। ক্ষুধা অনুভব হলে স্বাস্থ্যকর খাবার যেমন ফলমূল, বাদাম, খেজুর ইত্যাদি খেতে পারেন।
৩. কম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
প্রত্যেক বেলায় পেট ভরে খাওয়ার পরিবর্তে প্রয়োজনের তুলনায় একটু আহার করুন। এটি নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে।
মিকদাম ইবনে মা‘দীকারিব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সা.–কে বলতে শুনেছি:
“পেটের চেয়ে মন্দ কোন পাত্র মানুষ ভরাট করে না। পিঠের দাঁড়া সোজা রাখার মত কয়েক লোকমা খানাই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। আরো বেশী ছাড়া যদি তা সম্ভব না হয় তবে পেটের এক তৃতীয়াংশ খানার জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানির জন্য আরেক তৃতীয়াংশ শ্বাস–প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।” (জামে তিরমিযী, হাদীস নং: ২৩৮০)
৪. অপ্রয়োজনীয় কথা পরিহার করুন
কথা বলার আগে ভাবুন, এই কথাটি বলার প্রয়োজন আছে কি না। অপ্রয়োজনীয় কথা এড়িয়ে চলুন। এটি নফসকে নিয়ন্ত্রণের একটি শক্তিশালী উপায়।
৫. জিকিরের অভ্যাস করুন
প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যায় কিছু সময় জিকির-আজকারে কাটান। এটি আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
আবু মুসা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, আমি রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন:
“যে ব্যক্তি তার রবের যিক্র করে, আর যে ব্যক্তি যিক্র করে না, তাদের দু’জনের দৃষ্টান্ত হল জীবিত ও মৃতের ন্যায়।” (বুখারি: ৬৪০৭)
৬. ইশরাকের সালাত আদায় করুন
ইশরাকের সালাত নিয়মিত আদায় করুন। এটি আপনার দৈনন্দিন জীবনে আল্লাহর রহমত আনবে এবং নফসকে সংযত করবে।
আনাস (রা) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা.) বলেছেন:
”যে ব্যক্তি জামাআতের সাথে ফজরের নামায আদায় করে সূর্যোদয় পর্যন্ত সেখানে বসে আল্লাহর যিকির করবে এবং এরপর দু’রাকআত নামায আদায় করবে, তার জন্য একটি হজ্জ ও উমরা পালনের সাওয়াব হবে।
আনাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন: ঐ ব্যক্তির জন্য হজ্জ ও উমরার পরিপূর্ণ সাওয়াব হবে, পরিপূর্ণ সাওয়াব হবে, পরিপূর্ণ সাওয়াব হবে। (তিরমিজি: ৫৮৬)
৭. কুরআন পড়ুন
প্রতিদিন কুরআন পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। হতে পারে এক রুকু বা এক পারা। এটি অন্তরকে স্থির ও প্রশান্ত করবে এবং নফসের প্রবৃত্তিকে দূর করবে।
৮. কম ঘুমান
অতিরিক্ত ঘুমানো এড়িয়ে চলুন। দৈনিক ঘুমের সময় নির্দিষ্ট করে নফসের আরামপ্রিয়তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
৯. সকালে ব্যায়াম করুন
প্রতিদিন ফজরের পরে কিছুক্ষণ শারীরিক ব্যায়াম করুন। এটি আপনার শরীর ও মনের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
১০. দৃষ্টি অবনত রাখুন
নিজের দৃষ্টিকে হারাম জিনিস থেকে রক্ষা করুন। এটি আপনার নফসের কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে।
১১. সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার কমিয়ে আনুন
ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি থেকে মুক্ত হোন। অপ্রয়োজনীয় স্ক্রলিং এড়িয়ে চলুন।
১২. কুরআনের আয়াত মুখস্থ করুন
প্রতিদিন কুরআনের অন্তত এক আয়াত মুখস্থ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি আপনার আত্মিক উন্নতি সাধনে সহায়ক হবে।
১৩. রাতে ভরপেট খাওয়া এড়িয়ে চলুন
রাতে হালকা খাবার গ্রহণ করুন। ভরপেট খেলে নফস অলস হয়ে পড়ে এবং ইবাদতে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে যায়।
১৪. ঘুমানোর আগে ইবাদত করুন
ঘুমানোর আগে অজু করে দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করুন। এরপর ঘুম আসা পর্যন্ত আস্তাগফিরুল্লাহ যিকির করতে থাকুন।
১৫. তাহাজ্জুদ পড়ুন
নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি নফসকে সংযত রাখার অন্যতম সেরা উপায়।
নফসের নিয়ন্ত্রণ একটি দীর্ঘ ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা ধৈর্য, নিষ্ঠা এবং আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। উপরোক্ত ১৫টি কৌশল আপনার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই কৌশলগুলো নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে আপনি নিজেকে গোনাহের কাজ থেকে দূরে রাখতে পারবেন এবং আল্লাহর পথে অবিচল থাকতে পারবেন। নফসের বিরুদ্ধে এই জিহাদই প্রকৃত সফলতা অর্জনের প্রথম ধাপ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।