সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালা তার রাসুল সা.-এর নিকট নাজিল করেন সূরা আকালের প্রথম পাঁচ আয়াত। এরপর নাজিল করা হলো সূরা মুদ্দাসসিরের প্রাথমিক আয়াতগুলো। উক্ত আয়াতগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে আদেশ দেন; যেন তিনি তার কওমকে আল্লাহও দিকে আহ্বান জানান।
রাসুল সা. আল্লাহও আদেশ পালনার্থে মক্কার পুরুষ-নারী, ছোট-বৃদ্ধ, গোলাম-স্বাধীন সকলকে তাওহিদের আহ্বান জানান। তার আহ্বানে কতিপয় লোক ইমান আনে; তারাই ঐ সকল লোক, যাদের অন্তরগুলোকে আল্লাহ তায়ালা ইসলামের জন্য উন্মোক্ত করে দিয়েছেন।
তবে অধিকাংশ লোক তাওহিদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি। তারা রাসুল সা. এবং তার সাথীদের বিরোধিতা করতে শুরু করল। সাহাবিদের উপর চালাতো বিভিন্ন প্রকার জুলুম-নির্যাতন। তারা তাদেরকে মক্কার মরুর উপ্তপ্ত বালুকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রাখত।
অবশেষে আল্লাহ তায়ালা হাবশায় হিজরতের অনুমতি দেন। ফলে, হযরত জাফর বিন আবু তালেব রা.-এর নেতৃত্বে প্রায় ৮০ জন সাহাবী হাবশায় হিজরত করেন।
এভাবে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হলো। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা ইসলাম এবং মুসলমানদেরকে শক্তিশালী করার ইচ্ছা করলেন। তিনি মদিনার কতিপয় লোককে হেদায়াত দেন। ফলে তারা ইসলাম গ্রহণ করল। অবশেষে, মদিনায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়ল। মুসলমানদেরকে মদিনায় হিজরতের অনুমতি দেওয়া হয়। ফলে মুসলমানগণ দলে দলে মদিনায় হিজরত করেন।
মক্কায় কেবল রাসুল সা., আবু বকর রা. এবং চলা-ফেরায় অক্ষম কতিপয় মুসলমান অবশিষ্ট ছিলেন। আবু বকর রা. নিজের এবং রাসুল সা.-এর সফরের জন্য দুটি বাহন প্রস্তুত করে রাখেন। একদা রাসুল সা. আবু বকর রা.-এর ঘরে প্রবেশ করে জানালেন: ‘আমাকে হিজরতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’ আবু বকর রা. রাসুল সা. কে জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসুল! আমি কি আপনার সঙ্গী হতে পারি? রাসুল সা. উত্তরে হ্যাঁ বললেন। ফলে আবু বকর রা. আনন্দের আতিশয্যে কেঁদে উঠলেন।
তিনি সফরের প্রস্তুতি স্বরোপ দুটি বাহন প্রস্তুত রাখার কথা রাসুল সা. কে জানালেন। এর পাশাপাশি আবু বকর রা. আব্দুল্লাহ বিন উরাইকিতকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মজুরি হিসেবে নিয়োগ দেন, যেন তিনি মরুর পথ দেখিয়ে দিতে পারেন। আর সে ছিল একজন মুশরিক।
অবশেষে রাসুল সা. এবং আবু বকর রা. মদিনার পথে রওনা হলেন। রাসুল সা. গোপনে আল্লাহ তায়ালাকে ডাকতে লাগলেন। আর এটাই তো প্রকৃত তাকওয়া। রাসুল সা. সফরের পাথেয় সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর উপন ভরসা না করে আল্লাহও উপর ভরসা করেছেন।
মক্কায় রাসুল সা. এবং আবু বকর রা.-এর বেড়িয়ে পড়ার সংবাদ ছড়িয়ে গেল। কুরাইলরা ১০০ উট ঘোষণা করল ঐ ব্যক্তির জন্য, যে রাসুল সা. বা আবু বকর রা. কে জীবিত বা মৃত অবস্থায় এনে দিতে পারবে। রাসুল সা. হিজরতের পথে একটি গুহায় আশ্রয় নেন। কুরাইশ অনুসন্ধারকারী দল গুহার মুখে এসে উপনীত হলো। এ দৃশ্য দেখে আবু বকর রা. চিন্তিত হয়ে ভরতে লাগলেন: ‘যদি তারা তাদের পায়ের দিকে তাকায়, তাহলে আমাদেরকে দেখে ফেলবে।’ রাসুল সা. তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন: ‘ভয় পেয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ তিনি আরো বলেন: ‘তোমার ঐ দুই ব্যক্তি সম্পর্কে কী ধারণা! যাদের তৃতীয় জন হলেন আল্লাহ তায়ালা।’
অবশেষে কুরাইশ অনুসন্ধারকারী দল গুহার মুখ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। রাসুল সা. সে গুহায় তিন দিন অবস্থান করেন। এ সময়ে আসমা বিনতে আবু বকর রা. পানাহার নিয়ে গুহায় আসতেন।
তিন দিন অতিবাহিত হলে রাসুল সা. এবং আবু বকর রা. কে তালাশের বিষয়টি যখন সিথিল হয়ে গেলো। আব্দুল্লাহ বিন উরাইকিত তার নিকট আমানত রাখা দুটি গোলাম নিয়ে গুহার মুখে আগমন করেন। রাসুল সা. আবু বকর রা. কে বাহনের মূল্য পরিশোধ করে তাতে গুহারগুহার
পথিমধ্যে সুরাকা বিন মালেক কুরাইশদের পুরস্কার লাভের আশায় রাসুল সা.-এর পিছনে ধাওয়া করে। আল্লাহ তায়ালা সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনি তার রাসুলকে সুরাকা বিন মালেকের হাত থেকে রক্ষা করেন। আর সুরাকা বিন মালেক রাসুল সা. কে হত্যা সংকল্প করা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা তাকে রাসুল সা.-এর প্রতিরক্ষাকারী বানিয়ে পাঠিয়ে দেন।
অবশেষে রাসুল সা. এবং আবু বকর রা. মদিনায় পৌঁছেন। আবু বকর রা. লোকদেরকে স্বাগত জানাতে থাকেন। ফলে, লোকেরা ভাবতে লাগল যে, তিনি আল্লাহ নবী। এদিকে রাসুল সা. নীরবে বসে থাকেন। অতঃপর সূর্যের আলো রাসুল সা.-এর গায়ে পড়লে আবু বকর রা. স্বীয় চাদর দ্বারা রাসুল সা. কে আবৃত করে নেন। ফলে লোকেরা বুঝতে পারল যে, ইনিই প্রকৃত আল্লাহ রাসুল। এটা রাসুল সা.-এর উত্তম বিনয়ী ভাবের উপর দালালত করে।
হিজরত থেকে শিক্ষা:
হিজরত হলো রাসুল সা.-এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এতে রয়েছে বহু শিক্ষা। নিম্নে কয়েকটি হিজরত থেকে শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরা হলো:
১. নিজের জানমাল এবং নফসকে আল্লাহও আনুগত্যে সঁপে দেওয়া।
২. প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আল্লাহও উপর ভরসা করা।
৩. দুনিয়াবী বিষয়ের উপর পরকালীন বিষয়াদিকে প্রাধান্য দেওয়া।
৪. প্রয়োজনে অমুসলিম থেকে সাহায্য নেওয়া যায়। রাসুল সা. হিজরতের পথে আব্দুল্লাহ বিন উরাইকিত থেকে সাহায্য নিয়েছিলেন।
৫. এমনিভাবে মহিলাদের থেকে দ্বীনি কাজে সাহায্য নেওয়া যায়। আবু বকর রা.-এর কন্যা হজরত আসমা রা. হিজরতের পথে তিন দিন পানাহারের ব্যবস্থা করেছেন।
৬. বিপদের সম্মুখীন হলে না ভাবরানো। রাসুল সা. বলেছেন: ‘তুমি ভয় পেয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’
৭. দ্বীনের ধারক বাহক হলে আল্লাহ তায়ালা নিজ জিম্মায় তার বান্দাকে রক্ষা করবেন। যেমনিভাবে সুরাকা বিন মালেকের হাত থেকে রাসুল সা. কে রক্ষা করেছেন।