হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন নীলকর সাহেবদের দ্বারা নিগৃহীত ও নির্যাতিত দেশবাসীর কাছে মুক্তির স্বপ্ন পুরুষ। হিন্দু জমিদারদের দ্বারা উৎপীড়িত মুসলমানদের কাছে মুক্তির দূত। এ মহান পুরুষ ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান শরীয়তপুর জেলার মাদারীপুরের অন্তর্গত শামাইল নামক গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন।
আট বৎসর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর চাচা আযীম উদ্দীনের তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হন। ১৮ বৎসর বয়সে হজ করতে হিজাজ গমন করেন। সেখানে দীর্ঘ ২০ বছর অবস্থান করতঃ ইসলামী শরিয়ার বিভিন্ন বিষয়ে তিনি জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর ১৮১৮ সালে দেশে ফিরে স্বদেশের মানুষের হিদায়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
ফরায়েজী আন্দোলনের সূচনা ও প্রসার
মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে পূর্ণ ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়ন, নির্যাতিত মানুষের মাঝে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রতকরণ, পরাধীনতার শিকল ছিন্ন করে স্বাধীনতার মন্ত্রে মুসলমানদেরকে উজ্জীবিতকরণই ছিল তার সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য।
সে সময় কবর পূজা, পীরকে সিজদা করাসহ বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এ সকল বিদআত ও কুসংস্কার উচ্ছেদ করতঃ বিশুদ্ধ ইসলামী চিন্তাধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মানসে তিনি গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে মানুষকে বুঝাতে থাকেন।
‘ফরায়েজী আন্দোলন’ নামে প্রসিদ্ধির কারণ:
ইসলামের যে সকল ফরজ বিধান মানুষ ছেড়ে দিয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে তিনি অধিক গুরুত্বারােপ করতেন। এজন্য তার আন্দোলন ফরায়েজী আন্দোলন নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
তাছাড়া ইংরেজদের হাতে নিগৃহীত মানুষের মুক্তি এবং ইংরেজদের তল্পিবাহক হিন্দু জমিদারদের দ্বারা উৎপীড়িত মানুষের মুক্তির চিন্তাও তাকে দারুণভাবে বিচলিত করে। ইংরেজদের চক্রান্তের শিকার এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থার বিষয়টি তাকে দারুণভাবে বিচলিত করে তুলেছিল। তিনি মনে করতেন যে, ইংরেজদের অধীনতা স্বীকার করে নিয়ে এ দেশের মুসলমানদের জন্য সত্যিকারের ইসলামী জীবনাদর্শের অনুসরণ সম্ভব হবে না।
ফরায়েজী আন্দোলনের সাফল্য:
হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন বঙ্গের মুসলিম জাগরণের অগ্রপথিক। তার আদর্শ ও চিন্তা-চেতনার প্রভাবে সারা দেশে একটি ধর্মীয় জাগরণ সৃষ্টি হয়। তাঁর অবিচলতা ও অবিরাম কর্মতৎপরতার ফলে সারা দেশে ধীরে ধীরে আত্ম-সচেতনতা জাগরিত হয় এবং দলে দলে লোেকরা তার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকে। সারা দেশের মানুষকে নতুন চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে তিনি ঢাকা, বরিশাল, পাবনা ও ময়মনসিংহসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করেন এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেন। তার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক গণজাগরণ ইংরেজ নীলকর সাহেব ও তাদের পোষ্য শ্রেণির জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা এ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং মুসলমানদেরকে নানাভাবে হয়রানি করতে শুরু করে।
তার অব্যাহত কর্মতৎপরতার ফলে সারা দেশে মুসলমানদের মাঝে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল ফরায়েজীদের সাংগঠনিক তৎপরতার আওতায় চলে আসে।
হাজী শরীয়তুল্লাহ এর মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার:
১৮৪০ সালে এই সমাজসংস্কারক পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মুহসিন উদ্দীন দুদু মিয়া এ আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। ফরায়েজী আন্দোলনের অগ্রগতি ও সাংগঠনিক কর্ম তৎপরতায় তিনি তাঁর পিতাকেও ডিঙিয়ে গিয়েছিলেন।