হযরত সালমান ফারসি রা. বংশীয় দিক থেকে তিনি ইসপাহানের আবুল মালেক বংশের ছিলেন। তার পিতা ইসপাহানের ‘জি’ এলাকার জমিদার ছিলেন । তার পিতা অগ্নিকুণ্ডের উপাসনা করতেন। যেহেতু সালমান ফারসি রা. ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় পরিবেশে লালিত হোন, এজন্য অগ্নিপূজক থাকাকালে অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে অগ্নিপূজা করতেন।
অগ্নিপূজার প্রতি ঘৃণা এবং খ্রিষ্টাব্দের প্রতি ঝোঁক
একদা সালমান ফারসি রা. একটি গির্জা দেখতে পান। গির্জার আওয়াজ শুনতে পেয়ে কৌতূহলবশত ভেতরে প্রবেশ করেন। গির্জার দৃশ্য তার অন্তরে গভীর রেখাপাত করে। ধর্মীয় আচার-প্রথা শেষ হওয়ার পর তিনি খ্রিষ্টানদের জিজ্ঞেস করেন, এ ধর্মের মূল উৎস কোথায়? তারা বলল: সিরিয়ায়। তিনি ঘরে ফিরে আসেন।
পিতা জিজ্ঞেস করেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? সালমান রা. প্রতিউত্তরে বলেন: কিছু লোক গির্জায় ইবাদত করছিল, তাদের উপাসনা পদ্ধতি আমার অনেক ভালো লেগেছে। তাই সেখানেই সময় কাটিয়েছি। এতে সালমান রা.-এর পিতা বিচলিত হোন। তিনি হযরত সালমান ফারসি রা.-এর ধর্ম পরিবর্তনের আশঙ্কা করতে থাকেন। এজন্য তিনি সালমান ফারসি রা.-এর পায়ে বেড়ি পরিয়ে ঘরে বন্দি করে রাখেন।
হযরত সালমান ফারসি রা. খ্রিষ্টানদের বলে পাঠান: ‘যখন শাম থেকে বাণিজ্য কাফেলা আগমন করবে, আমাকে অবগত করবেন।’ সে অনুযায়ী বাণিজ্য কাফেলা আগমন করলে তাকে খবর দেওয়া হয়। তিনি বেড়িমুক্ত হয়ে ওই কাফেলার সাথে যুক্ত হয়ে শামে চলে যান। শামে পৌঁছে লোকদের জিজ্ঞেস করেন, এখানকার সবচেয়ে বড় ধর্মীয় পণ্ডিত কে? লোকেরা তাকে জনৈক পাদ্রির সন্ধান দেয়। তিনি পাদরিকে বলেন, আপনাদের খ্রিষ্টধর্ম আমার পছন্দ হয়েছে। আমি আপনার নিকট থেকে ধর্মীয় দীক্ষা গ্রহণ করতে চাই। আপনি আমাকে এ ধর্মে দীক্ষিত করুন।’
তিনি যেই পাদ্রির নিকট এসেছিলেন সে ছিল অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ। লোকজনকে দান-সদকা করার জন্য উৎসাহিত করত অথচ নিজে অর্থ আত্মসাৎ করত। এভাবে আত্মসাৎ করার ফলে তার নিকট সাত মটকা স্বর্ণ-রৌপ্য জমা হয়ে যায়।
সালমান রা. তার এমন লোভ-লালসা দেখে অত্যন্ত বিচলিত হোন; তিনি মুখে কিছু বলতেন না। ওই পাদরি মারা গেলে খ্রিষ্টানরা বেশ আড়ম্বরের সাথে তার কাফন-দাফনের জন্য সমবেত হল। সালমান ফারসি রা. পাদ্রির সকল গোপন বিষয় লোকদের সামনে তুলে ধরেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, তুমি এগুলো কীভাবে জানলে? তখন সালমান ফারসি রা. তাদেরকে পাদ্রির অসৎ উপায়ে অর্জিত ধন ভান্ডারের কাছে নিয়ে যান। লোকেরা বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরে শাস্তিস্বরূপ পাদরিকে দাফন করার পরিবর্তে ক্রুশে ঝুলিয়ে পাথর নিক্ষেপ করে ।
এরপর নতুন এক পাদরি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নতুন এই পাদরি ছিল অত্যন্ত ইবাদতগুজার ও দুনিয়া বিরাগী। রাত-দিন আল্লাহ তায়ালার েইবাদতে মগ্ন থাকতেন। তাই সালমান ফারসি রা. তার প্রতি আকৃষ্ট হোন। যখন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসে, সালমান রা. তাকে বলেন: আমি তো আপনার নিকট দীর্ঘ সময় অবস্থান করেছি, এখন আপনি জীবনের অন্তিমলগ্নে চলে এসেছেন, আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন। আপনার পর আমি কার কাছে যাব?
তিনি বলেন, আমার জানা মতে এখন এমন কোনো খ্রিষ্টান নেই, যে খ্রিষ্টান ধর্মের সত্যিকারের অনুসারী। হ্যাঁ, তবে মুসেল শহরে একজন পাদরি আছেন, যিনি সত্য দীনের সত্যিকারের অনুসারী। তুমি তার সাথে সাক্ষাৎ করো ।
মুসেলে যাত্রা
পাদ্রির মৃত্যুর পর সালমান রা. সত্যধর্ম তালাশে মুসেলে পৌঁছেন। তালাশ করে পাদ্রির সাক্ষাৎ পান। তাকে সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে বলেন যে, অমুক পাদরি আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। পাদরি সালমান রা.-কে অবস্থানের অনুমতি প্রদান করেন। পূর্বের পাদ্রির বক্তব্য অনুযায়ী এই পাদরি বাস্তবেই অত্যন্ত খোদাভীরু ও পরহেজগার ছিল। এই পাদরিরও অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছিল। সালমান রা. তাকে অসিয়ত করতে বললে নাসিবাইন শহরের এক পাদ্রির ঠিকানা দেন ।
নাসিবাইনের পথে
সালমান রা. পাদ্রির মৃত্যুর পর নাসিবাইনের পাদ্রির সন্ধানে বের হন। তার সাথে সাক্ষাৎ করে আগের পাদ্রির অসিয়তের কথা বলেন। এ পাদরিও পূর্বের দুই পাদ্রির মতো বড় ইবাদত প্রাণ এবং দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। সালমান রা. কিছুদিন মাত্র তার সাহচর্য লাভ করেছিলেন, এরই মধ্যে তারও অন্তিম সময় চলে আসে। সালমান রা. পূর্বের পাদ্রিদের মতো তাকে অসিয়ত করতে বললে; তখন পাদরি আমুরিয়ার এক রত্নের সন্ধান দেন।
আমুরিয়ার উদ্দেশে
নাসিবাইনের পাদ্রির মৃত্যুর পর তিনি আমুরিয়ার পথে যাত্রা করেন। সেখানকার পাদ্রির সাথে সাক্ষাৎ করে পূর্বের পাদ্রির অসিয়তের কথা বলেন। এরপর তার নিকট তিনি অবস্থান শুরু করেন। এরই মধ্যে সালমান রা. কিছু বকরি ক্রয় করেছিলেন, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি পার্থিব খোরাক অর্জন করতেন আর ওই পাদ্রির নিকট থেকে আধ্যাত্মিক খোরাক লাভ করতেন।
এক পর্যায়ে যখন এ পাদ্রির জীবন ওষ্ঠাগত হওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো, তিনি তাকে অসিয়ত করতে বলেন। পাদরি তখন বলেন, বৎস! আজ দুনিয়াতে এমন কোনো মানুষ নেই; যার নিকট অবস্থানের পরামর্শ আমি তোমাকে দিতে পারি। এখন নতুন নবীর আবির্ভাবের সময় খুব নিকটবর্তী হয়ে গেছে, আরবের মরুভূমিতে আবির্ভাব হবে, যিনি দ্বীনে ইবরাহিমকে জীবিত করবেন, খেজুর বাগান বিশিষ্ট ভূখণ্ডে হিজরত করবেন।
তার আলামত হলো: তিনি কখনো সদকা গ্রহণ করবেন না। দান-সদকা নিজের জন্য হারাম মনে করবেন। তার উভয় কাঁধের মাঝে নবুওয়াতের মোহর থাকবে। যদি তুমি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পার, তাহলে অবশ্যই করবে।
আরবের পথে সালমান ফারসি রা.
পাদ্রির মৃত্যুর পর সালমান রা. দীর্ঘ একটা সময় আমুরিয়াতে অবস্থান করেন। কিছুদিন পর এক ব্যবসায়ী কাফেলা সেখান দিয়ে অতিক্রম করে। সালমান রা. তাদেরকে বলেন, ‘যদি তোমরা আমাকে আরবে পৌঁছে দাও, তাহলে আমি আমার মালিকানাধীন গাভি-বকরি তোমাদের দিয়ে দেব।’ তারা এতে রাজি হল। কিন্তু বনু কালব গোত্রের ওই কাফেলা ‘ওয়াদিল কুরা’ নামক স্থানে পৌঁছে সালমান রা.-কে ধোঁকা দেয়। তারা তাকে গোলাম হিসেবে এক ইহুদির নিকট বিক্রি করে দেয়। নতুন মনিব সালমান রা.-কে তার চাচাতো ভাইয়ের নিকট বিক্রি করে দেন।
মদিনার পথে
নতুন মনিব তাকে নিয়ে মদিনার পথে রওনা হোন। এই তো সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গা। এখানেই তো একদিন শেষ নবি আগমন করবেন। সালমান রা. অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন। অবশেষে মদিনার আকাশে নব সূর্য উদিত হলো। সালমান রা.-এর অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদিনায় চলে আসেন। সালমান রা. নবিজি সা.-এর আগমনের সংবাদ জানতে পেরে তার হাতে থাকা খাবার নিয়েই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হন। কিছু খাবার সদকা করলে নবিজি সা. তা সাথীদের মাঝে বণ্টন করে দেন। নিজে কিছুই গ্রহণ করলেন না। সালমান রা.-এর সামনে নবুওয়াতের একটি আলামত সুস্পষ্ট হলো যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকা গ্রহণ করেন না।
দ্বিতীয় দিন… তিনি কিছু হাদিয়া নিয়ে হাজির হয়ে বলেন, গতকাল আপনি সদকা গ্রহণ করলেন না; তাই আজ হাদিয়া নিয়ে এসেছি। এগুলো গ্রহণ করুন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা গ্রহণ করেন । নিজেও আহার করেন এবং অন্যদের তা আহার করান।
অতঃপর সালমান রা. নবুওয়াতের অন্যতম নিদর্শন অর্থাৎ মোহরে নবুওয়াত দেখে নেন এবং অভিভূত হয়ে সেই মোহরে চুমু খাওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়েন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বলেন, সামনে এসো। সালমান রা. সামনে এসে জীবনের পুরো বৃত্তান্ত শোনান। তার ঈমানদীপ্ত দাস্তান নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এতই ভালো লাগে যে, তিনি সকল সাহাবিকে তা শোনান ।