ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে রোজা পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ ও ইবাদত। এটি আমাদের নফসকে কলুষমুক্ত ও পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়তা করে। রোজাদার ব্যক্তির জন্য কিছু নিয়ম পালন করা আবশ্যক। তা পালন না করলে রোজা ভেঙ্গে যায়। এই প্রবন্ধে আমরা রোজা ভঙ্গের কারণ এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করবো।
এছাড়া, রোজা ভঙ্গের কারণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহীদের জন্য এই প্রবন্ধে রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ নিয়ে একটি PDF ডাউনলোড লিংকও দেওয়া থাকবে। যার মাধ্যমে আপনি আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন।
রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ
১. ইচ্ছাকৃত পানাহার করা
রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ করলে রোজা ভেঙে যায়। কেউ ভুলক্রমে খেয়ে ফেললে রোজা ভেঙ্গে যায় না। হয় না, তবে ইচ্ছাকৃত খাওয়া রোজার শর্ত লঙ্ঘন করে।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন:
“রোযা পালনকারী যদি ভুলক্রমে খায় বা পান করে তবে, সে তার রোযা পূর্ণ করবে। কেননা আল্লাহ তাআলাই তাকে আহার করিয়েছেন ও পান করিয়েছেন।”
– সহীহ মুসলিম: হাদীস নং: ২৫৮৭
২. স্ত্রী সহবাস করা
রোজা থাকা অবস্থায় সহবাস করলে রোজা ভেঙে যায় এবং এর কাফ্ফারা আদায় করতে হয়।
৩. কুলি করার সময় হলকের নিচে পানি চলে যাওয়া
রোজা অবস্থায় কুলি করার সময় অসাবধানতাবশত পানি যদি হলকের (গলার গভীর অংশ) নিচে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে। তবে, যদি ভুলক্রমে এমন হয় এবং রোজার কথা স্মরণ না থাকে, তাহলে রোজা ভাঙবে না।
৪. ইচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি করা
রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি করলে রোজা ভেঙে যায়। তবে যদি স্বাভাবিকভাবে বমি হয়, তাহলে তাতে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না।
৫. নাকে ঔষধ বা তেল প্রবেশ করানো
রোজার সময় নাকে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ঔষধ বা তেল দেওয়া হয় এবং তা ভিতরে প্রবেশ করে, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে।
৬. জোরপূর্বক পানাহার করানো
কাউকে জোরপূর্বক খাবার বা পানীয় গ্রহণ করালেও তার রোজা ভেঙে যাবে এবং পরবর্তীতে তাকে এবটি রোজা কাজা করতে হবে।
৭. লোাহা, পাথর, প্লাস্টিক বা অখাদ্য কিছু গিলে ফেলা
রোজার সময় কোনো অখাদ্য বস্তু যেমন পাথর, লোহা, প্লাস্টিক বা মাটি ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যায়।
৮. সূর্যাস্ত হয়ে গেছে মনে করে ইফতার করার পর দেখা গেল সূর্যাস্ত হয়নি
রোজাদার ব্যক্তি ইফতারের জন্য সূর্যাস্তের সময় নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ ভুলক্রমে সূর্যাস্ত হয়েছে মনে করে ইফতার করেন এবং পরে নিশ্চিত হন যে সূর্যাস্ত হয়নি; তাহলে তার রোজা ভেঙে যাবে।
এক্ষেত্রে ঐ দিনের রোজা কাজা করতে হবে, কাফ্ফারা দিতে হবে না।
৯. রোজার নিয়ত না করে পানাহার থেকে বিরত থাকলে রোজা হয় না
যদি কেউ শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকে এবং রোজার নিয়ত না করেন, তবে এটি রোজা হিসেবে গণ্য হবে না।
১০. মুখের ভেতরে থাকা ছোলা পরিমাণ খাদ্য গিলে ফেলা অথবা মুখের বাইরে থেকে সামান্য পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করা
রোজা অবস্থায় মুখের ভেতরে থাকা ছোলা পরিমাণ খাদ্য গিলে ফেললে বা বাইরে থেকে সামান্য পরিমাণ খাবার গ্রহণ করলেও রোজা ভেঙে যাবে।
১১. ধূমপান করা
ধূমপান করা রোজা ভঙ্গের অন্যতম কারণ। কাজেই রোজা অবস্থায় এর থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
১২. রাত অবশিষ্ট আছে মনে করে সুবহে সাদিকের পর পানাহার করা
যদি কেউ ভুল করে মনে করেন রাত এখনও বাকি এবং সুবহে সাদিক হওয়ার পরও পানাহার করেন, তবে রোজা ভেঙে যাবে। এক্ষেত্রে কাজা ওয়াজিব হবে।
রোজা অবস্থায় যে সকল কাজ করা মাকরুহ:
এমন কিছু কাজ রয়েছে, যা রোজা অবস্থায় করা মাকরুহ। এসকল কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। নিচে রোজা অবস্থায় মাকরুহ কাজগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১. অপ্রয়োজনীয় কোনো বস্তু চিবানো বা চাখা
রোজা অবস্থায় অপ্রয়োজনীয় কোনো খাদ্য বা দ্রব্য চিবানো বা চাখা মাকরুহ।
২. কোনো দ্রব্য মুখে দিয়ে রাখা
রোজা অবস্থায় কোনো দ্রব্য যেমন পাতা, কাঠি বা অন্য কিছু মুখে দিয়ে রাখা মাকরুহ।
৩. মুখে পানি গড়গড় করা বা নাকে পানি টেনে নেওয়া
রোজা অবস্থায় প্রয়োজন ছাড়া বারবার গড়গড়া করা বা নাকের পানি ভেতরে টেনে নেওয়া মাকরুহ। যদি অসাবধানতায় পানি গলায় চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে।
৪. ইচ্ছাকৃত মুখে থুথু জমা করে গলাধঃকরণ করা
রোজা অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে মুখের লালা গিলে ফেলা মাকরুহ নয়, তবে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখে থুথু জমিয়ে তা গলাধঃকরণ করা মাকরুহ। এটি আদবের পরিপন্থী কাজ।
৫. গীবত, গালি-গালাজ ও ঝগড়া-ফাসাদ করা
আত্মসংযম ও নিজের গোনাহ থেকে বিরত রাখা রোজার অন্যতম শিক্ষা। গীবত (পরনিন্দা), গালি-গালাজ, এবং ঝগড়া-ফাসাদ রোজার সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়।
হযরত আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং খারাপ কাজ করা পরিত্যাগ করে না, তার পানাহার থেকে বিরত থাকা আল্লাহর কাছে কোনো মূল্য রাখে না।”
– (সহিহ বুখারি: ১৭৮২)
শিক্ষা: যদি কেউ ঝগড়া করতে আসে, তবে বলতে হবে: “আমি রোজাদার।”
৬. সারা দিন নাপাক অবস্থায় থাকা
রোজার সময় সারা দিন নাপাক অবস্থায় থাকা মাকরুহ। এটি ইবাদত এবং পবিত্রতা রক্ষা করার মূল শিক্ষার পরিপন্থী।
৭. অস্থিরতা বা বিরক্তি প্রকাশ করা
রোজা হলো ধৈর্যশীলতার পরীক্ষা। অস্থিরতা বা বিরক্তি প্রকাশ করা রোজার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
৮. টুথ পাউডার, পেস্ট বা দাঁতের মাজন দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা
রোজার সময় মাজন, টুথপেস্ট বা অন্য কোনো পাউডার ব্যবহার করে দাঁত পরিষ্কার করা মাকরুহ। কারণ এতে সামান্য অংশ গলায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিকল্প হিসেবে মিসওয়াক ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যেন মিসওয়াকের কোনো ভেঙে অংশ গলার ভেতরে চলে না যায়।
রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ PDF ডাউনলোড করুন
আপনি যদি রোজা ভঙ্গের কারণ, মাকরুহ কাজ, এবং বৈধ কারণে রোজা না রাখার নির্দেশিকা সহজে সংরক্ষণ করতে চান, তাহলে এই PDF ফাইলটি ডাউনলোড করুন। এই ফাইলটি বিস্তারিত তথ্যসহ সুনির্দিষ্টভাবে তৈরি করা হয়েছে।
PDF-এর বৈশিষ্ট্যসমূহ:
- রোজা ভঙ্গের ৮টি কারণ
- মাকরুহ কাজের তালিকা
- রোজা না রাখার বৈধ কারণ এবং কাজা করার নিয়ম
- প্রয়োজনীয় ইসলামের নির্দেশনা এবং প্রাসঙ্গিক হাদিস
PDF ডাউনলোড লিংক:
যেসব কারণে রোজা না রাখার এবং পরবর্তীতে কাজা করার অনুমতি রয়েছে
ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। আল্লাহ তায়ালা বান্দার সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, কঠোরতা চান না।”
(সূরা আল-বাকারা: ১৮৫)
রোজা একটি ফরজ ইবাদত হলেও এমন কিছু পরিস্থিতি রয়েছে, যেখানে শরিয়ত রোজা না রাখার অনুমতি দিয়েছে। তবে এই সুবিধা সাময়িক, এবং পরে সেই রোজাগুলো কাজা (পুনরায় পালন) করতে হয়। নিচে রোজা না রাখার বৈধ কারণসমূহ এবং তাদের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো।
১. এমন কোনো রোগাগ্রস্ত হওয়া, যার ফলে রোজার রাখার শক্তি হারিয়ে ফেলে
যদি রোজাদার এমন কোনো রোগাগ্রস্ত হয় যে, তার রোজার রাখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে অথবা রোগ বৃদ্ধির ভয় হয়। তাহলে রোজা না রাখার অনুমতি আছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ বা সফরে থাকবে, সে অন্য কোনো সময়ে এই সংখ্যা পূরণ করবে।”
(সূরা আল-বাকারা: ১৮৪)
২. গর্ভবতী নারীর নিজের বা সন্তানের প্রাণহানির আশঙ্কা
যদি গর্ভবতী নারীর রোজা রাখার ফলে তার নিজের জীবন বা গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তবে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে।
৩. দুধ পান করানো নারীদের ক্ষেত্রে
রোজা রাখার ফলে দুধ কমে যায় এবং সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাদের রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে।
৪. সফরে থাকা (মুসাফির) ব্যক্তির জন্য রোজা না রাখা বৈধ
যদি কেউ শরিয়তসম্মত সফরে (সফরটি ৪৮ মাইল বা তার চেয়ে বেশি হতে হবে) থাকেন, তবে তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি আছে। তবে, রোজা রাখা কষ্টকর না হলে রোজা রাখা উত্তম।আল্লাহ তাআ’লা বলেন:
“যে অসুস্থ বা সফরে থাকবে, তার জন্য অন্য সময়ে রোজা পূরণ করা যাবে।”
(সূরা আল-বাকারা: ১৮৫)
৫. হত্যার হুমকি দেওয়া হলে
যদি কাউকে রোজা রাখার কারণে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়, তবে তার জন্য রোজা ভঙ্গ করার অনুমতি রয়েছে। রোজা ভঙ্গ করলে পরে কাজা আদায় করতে হবে।
৬. রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা
যদি কোনো রোগীর ক্ষুধা বা পিপাসা এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে, দ্বীনদার মুসলিম চিকিৎসকের মতে রোজা রাখলে তার মৃত্যু হতে পারে, তবে রোজা ভঙ্গ করা ওয়াজিব এবং পরে সেই রোজাগুলোর কাজা করতে হবে
৭. হায়েজ-নেফাসগ্রস্ত নারীদের জন্য রোজা রাখা জায়েজ নয়
মহিলারা মাসিক (হায়েজ) বা সন্তান প্রসব-পরবর্তী রক্তস্রাব (নেফাস) অবস্থায় রোজা রাখতে পারবেন না। পরবর্তীতে এই রোজাগুলো কাজা করতে হবে।