ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের রয়েছে স্বতন্ত্র অর্থব্যবস্থা; যা প্রচলিত ধর্মগুলোতে অনুপস্থিত। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় রিবাকে একটি ঘৃণীত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেননা রিবা সমাজে অসম বণ্টন নিশ্চিত করে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে।
অপরদিকে রিবার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হওয়া সত্ত্বেও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় রিবা গ্রহণকে কেবল বৈধতা প্রদান করা হয়নি; বরং এটিকে ‘সম্পদ উপকরণ’ হিসেবে গণ্য করা হয়। যা পরিণামে পুঁজিপতিদের সম্পদে একচ্ছত্র মালিকানা লাভে সহায়তা করে।
রিবার ফাঁদে কারবারে সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের শিকার হোন আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারগুলো। বাড়ি-ভিটা সর্বত্র হারিয়ে তাদের নিঃস্ব হতে হয়।
কুরআন ও হাদিসের আলোকে নিষিদ্ধ রিবা:
কুরআনুল কারীমে রিবা (সুদ) শব্দটি তার প্রসিদ্ধ অর্থে সাত স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। ألف-لام সহ সাত স্থানে আর ألف-لام ছাড়া এক স্থানে।। তাছাড়া বিভিন্নভাবে রূপান্তরিত হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে মোট দশটি স্থানে।
সর্বপ্রথম রিবা সম্পর্কীয় আয়াত মক্কায় অবতীর্ণ হয়। বিদায় হজের ভাষণে নবীজি সা. সকল প্রকার রিবা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
কুরআনে রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার ধাপ সমূহ:
বান্দার কল্যাণকর বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অধিক অবগত। তিনি বান্দার কল্যাণ চান এবং বান্দাকে অকল্যাণ থেকে দূরে রাখেন। রিবা কেবল মুসলমানদের ওপর নিষিদ্ধ করা হয়নি; বরং ইহুদিদের ওপরও রিবাকে নিষিদ্ধ করেছিলেন।
প্রথম ধাপ:
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَمَآ ءَاتَيْتُم مِّن رِّبًۭا لِّيَرْبُوَ فِىٓ أَمْوَٰلِ ٱلنَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ ٱللَّهِ ۖ وَمَآ ءَاتَيْتُم مِّن زَكَوٰةٍۢ تُرِيدُونَ وَجْهَ ٱللَّهِ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُضْعِفُونَ.
অর্থ: আর যা কিছু ‘বর্ধক’ সম্পদ তোমরা ব্যয় কর, যাতে মানুষের সম্পদে যুক্ত হয়ে (তোমাদের জন্য তা বর্ধন করে এবং) বর্ধিতরূপে ফিরে আসে, তো আল্লাহর নিকট কিন্ত তা (বিলকুল) বাড়ে না। পক্ষান্তরে যা কিছু যাকাত (ও দান) তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি চেয়ে দান করবে, তো তারাই আসলে (নিজেদের সম্পদ) বর্ধনকারী।
– সূরা রূম: ৩৯, বঙ্গানুবাদ: কোরআনুল কারীমের তারজুমানী – আবু তাহের মিসবাহ।
রিবা সম্পর্কে এটি কুরআনুল কারীমের সর্ব প্রথম আয়াত। এ আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ। এ আয়াতে রিবা (সুদ) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ভবিষ্যতে উত্তম কিছু হাদিয়া দিবে – এ আশায় কাউকে কোনো কিছু হাদিয়া দেওয়া।
দ্বিতীয় ধাপ:
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
فَبِظُلْمٍۢ مِّنَ ٱلَّذِينَ هَادُوا۟ حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَٰتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ كَثِيرًۭا. وَأَخْذِهِمُ ٱلرِّبَوٰا۟ وَقَدْ نُهُوا۟ عَنْهُ وَأَكْلِهِمْ أَمْوَٰلَ ٱلنَّاسِ بِٱلْبَٰطِلِ ۚ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَٰفِرِينَ مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًۭا.
অর্থ: ১৬০. মোট কথা, যারা ইহুদিয়াত গ্রহণ করেছিল তাদের পক্ষ থেকে অনাচারের কারণেই আমি কিছু উত্তম বস্তু তাদের ওপর হারাম করে দিয়েছিলাম, যা (আগে) তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল। (এটা ঘটেছিল) আরো এ কারণে যে, অনেকভাবে (মানুষকে) তারা আল্লাহর রাস্তা থেকে বাধা দিয়ে রাখত, ১৬১. আর তারা সুদ গ্রহণ করত, অথচ (তাওরাতে) তা থেকে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল, আর মানুষের সম্পদ তারা অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করত। ইর তাদের মধ্য হতে যারা কাফির তাদের জন্য আমি যন্ত্রণাদায়ক আজাব তৈয়ার করে রেখেছি।
– সূরা নিসা: ১৬০-১৬১, বঙ্গানুবাদ: কোরআনুল কারীমের তারজুমানী – আবু তাহের মিসবাহ।
এই আয়াতটি ইহুদিদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তায়ালা ইহুদিদের ওপর রিবা হারাম করেছিলেন। তবুও তারা রিবা গ্রহণ করত। এ আয়াতে মুসলমানদের ওপর রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। বরং রিবা গ্রহণের মাধ্যমে ইহুদিদের সীমালঙ্ঘনের কথা বলা হয়েছে।
তৃতীয় ধাপ:
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَأْكُلُوا۟ ٱلرِّبَوٰا۟ أَضْعَـٰفًۭا مُّضَـٰعَفَةًۭ ۖ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ.
অর্থ: আয় আহলে ঈমান! (শোনো), তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেয়ো না; আর তোমরা আল্লাহকে সমীহ কর, যাতে সফলকাম হতে পারো।
– সূরা আলে ইমরান: ১৩০, বঙ্গানুবাদ: কোরআনুল কারীমের তারজুমানী – আবু তাহের মিসবাহ।
এ আয়াতটি মদিনায় অবর্তীণ হয়। উক্ত আয়াতে কয়েক গুণ বাড়িয়ে রিবা গ্রহণ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। তৎকালীন সমাজে রিবার প্রচলিত পদ্ধতি এমনই ছিলো বিধায় উক্ত আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে, অল্প রিবা গ্রহণ বৈধ।
আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী রহ. লিখেন:
“প্রথম কথা হলো, রিবা অল্প বা বেশি – সবই হারাম। দ্বিতীয়ত রিবা গ্রহণের এই প্রক্রিয়া আরো জঘন্য ও ঘৃণীত। এটি এমন হলো, যেমন কেউ অপরকে বলল: ভাই! মসজিদে গালি-গালাজ করো না। এর উদ্দেশ্য এটি নয়, মসজিদের বাইরে গালিগালাজ করা যাবে। বরং অধিক জঘন্য ও ঘৃণিত অবস্থা বোঝানোর জন্য এমন শব্দ বলা হয়।”
চতুর্থ ধাপ:
চতুর্থ ধাপে আল্লাহ তায়ালা সকল প্রকার রিবাকে নিষিদ্ধ করেন এবং রিবায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ۗ وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ۚ فَمَن جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىٰ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَنْ عَادَ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (275) يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ (276) إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (277) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ (278) فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ۖ وَإِن تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ.
অর্থ: ২৭৫. যারা সুদ খায় (কিয়ামতের দিন) তারা সেভাবেই ওঠবে যেমন ওঠে, শয়তান যাকে অপস্পর্শ দ্বারা অপ্রকৃতিস্থ করে দিয়েছে। ঐ সাজা এজন্য যে, তারা বলেছিল, বিক্রি তো সুদেরই মতো। অথচ (প্রকৃত বিষয় হলো,) আল্লাহ বিক্রিকে হালাল করেছেন, আর সুদকে হারাম করেছেন। তো যার কাছে তার রবের পক্ষ হতে উপদেশ এসেছে, অনন্তর (সুদের লেনদেন থেকে) সে বিরত থেকেছে তাহলে পিছনের লেনদেন তার অনুকূলে (ক্ষমাযোগ্য), পক্ষান্তরে তার (ভিতরের) অবস্থা আল্লাহর এখতিয়ারে অর্পিত। আর যে (আবার সুদের লেনদেন দিকে) ফিরে যাবে, ওরাই আছহাবে নার-জাহান্নামী। তাতে তারা চিরকাল থাকবে। ২৭৬. আল্লাহ তো সুদকে সংকুচিত/বিলুপ্ত করেন, আর দান-ছাদাকা বর্ধিত/সমৃদ্ধ করেন। বস্তুত আল্লাহ প্রত্যেক কৃতঘ্ন পাপিষ্ঠকে অপছন্দ করেন। ২৭৭. যারা ঈমান আনে এবং নেক আমলে মগ্ন থাকে, আর সালাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে তাদের রবের নিকট তাদের জন্য অতি অবশ্যই রয়েছে পূর্ণ প্রতিদান। আর (সেদিন) তাদের উপর কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না। ২৭৮. আয় আহলে ঈমান! (শোনো,) তোমরা আল্লাহকে সমীহ কর, আর সুদের যে অংশ (কারো কাছে পাওনা) রয়ে গিয়েছে, ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো। ২৭৯. তো যদি তোমরা (তা) না কর তাহলে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ হতে। পক্ষান্তরে যদি তোমরা (সুদের লেনদেন থেকে) তওবা কর তাহলে তোমাদের মূল পুঁজি তোমাদের জন্য নিরাপদ থাকবে; না তোমরা জুলুম করবে, আর না তোমরা মাজলুম হবে।
– সূরা বাকারা: ২৭৫-২৭৯, বঙ্গানুবাদ: কোরআনুল কারীমের তারজুমানী – আবু তাহের মিসবাহ।
উপরিউক্ত আয়াতগুলো ৮ম হিজরীতে মদিনায় অবতীর্ণ হয়। উক্ত আয়াতগুলোতে কম-বেশি সকল প্রকার রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়।
এমনকি ইতিমধ্যে যারা রিবায় জড়িয়ে পড়েছিল তাদের ক্ষেত্রে বিধান নাজিল করা হয়েছে যে, ঋণগ্রহীতা মূলধন ফেরত দিবে আর ঋণদাতা শুধুমাত্র মূলধন ফেরত পাবে ।
সে সময় আরবের বনু ছাফিক ও বনু মুগিরা গোত্রদ্বয়ের মাঝে রিবার একটি চুক্তি ছিল। বনু মুগিরা গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করলে রিবার বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য রাসুল সা. এর কাছে আগমন করেন। রাসুল সা. এভাবে মীমাংসা করেন যে, বনু মুগীরা বনু ছাকিফকে কেবল মূলধন ফেরত দিবে।
রিবা নিষিদ্ধ সম্পর্কীয় হাদিস:
ألا كل شيء من أمر الجاهلية تحت قدمي موضوع ودماء الجاهلية موضوعة وإن أول دم أضع من دمائنا دم ابن ربيعة بن الحارث كان مسترضعا في بني سعد فقتلته هذيل. وربا الجاهلية موضوع وأول ربا أضع ربانا ربا عباس بن عبد المطلب فإنه موضوع كله.
অর্থ: তোমরা জেনে রাখো! জাহিলি যুগের সকল কিছু আমার পদদ্বয়ের তলে পরিত্যক্ত হল। জাহিলি যুগের রক্ত বা প্রতিশোধের দাবি বাতিল হল। আমাদের (আব্দুল মুত্তালিব) বংশের রক্তই সর্বপ্রথম বাতিল করছি। তা হল রাবিআ বিন হারিসের পুত্রের রক্ত বা প্রতিশোধের দাবি, যে বনু সা’দ গোত্রে দুগ্ধপোষ্য হিসাবে ছিল। হুযাইল গোত্র তাকে হত্যা করে। এবং জাহিলি যুগের প্রাপ্য সুদ বাতিল করা হল। সর্বপ্রথম যে প্রাপ্য সুদ বাতিল করছি তা আমাদের (আব্দুল মুত্তালিব) বংশের সুদ। তা হল আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিবের সুদ। তা সবই বাতিল ।
– সহীহ মুসলিম। হাদিস নং: ২৮২১
ইসলামে রিবার তাৎপর্য:
ইসলামে রিবার মূল তাৎপর্য তিনটি:
১. রিবা শরীয়াহ নিষিদ্ধ ও হারাম লেনদেন।
২. সদি একটি বিনিময়হীন লেনদেন।
৩. أكل المال بالباطل – অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভোগকে নিশ্চিত করে।
এভাবে সকল প্রকার রিবাকে কুরআন ও হাদিসে নিষিদ্ধ করা হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সুদমুক্ত জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলার তওফিক দান করুন। আমীন।