কুরআন-হাদিসে নিষিদ্ধ রিবার বহু প্রকার রয়েছে। আমাদের সমাজে প্রচলিত সুদ এর একটি প্রকার মাত্র। পূর্বে প্রকাশিত প্রবন্ধে রিবার পরিচিতি, ভয়াবহতা, শাস্তি ও কুরআনে রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার ধাপগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বক্ষমাণ প্রবন্ধে রিবার প্রকারভেদ ও সমাজে এর প্রয়োগিক দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে। আশা করছি, বক্ষমাণ প্রবন্ধে সুদের প্রকারভেদ ও প্রয়োগিক দিকগুলো জানতে পারবেন।
ইসলামে নিষিদ্ধ রিবা প্রথমত দুই প্রকার।
- রিবাল কুরআন।
- রিবাল হাদিস।
রিবাল কুরআন এর পরিচিতি ও প্রকারভেদ:
কুরআনে বর্ণিত রিবাকে ‘রিবাল কুরআন’ বলা হয়। একে ‘রিবাল জাহিলিয়্যাহ’ ও বলা হয়।
রিবাল কুরআন দুই প্রকার। যথা:
- রিবার করদ – ঋণের ওপর আরোপিত সুদ।
- রিবার দাইন –দায়ের ওপর আরোপিত সুদ।
রিবার করদ এর পরিচিতি ও প্রয়োগিক দিক:
রিবার করদ বলা হয়, ঋণ দিয়ে ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত কোনো অর্থ বা সুবিধা গ্রহণ করা। আমাদের সমাজে এ প্রকারের রিবা অধিক প্রচলিত। রিবাল করদের কিছু প্রসিদ্ধ প্রায়োগ দিক তুলে ধরা হলো:
১. অতিরিক্ত পরিশোধের শর্তে ঋণ দেওয়া। যেমন: ১২ হাজার টাকা পরিশোধের শর্তে ১০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া। – এখানে অতিরিক্ত ২ হাজার টাকা রিবা হিসেবে গণ্য হবে।
২. ঋণের বিপরীতে টাকা নয়, বরং কোনো সুবিধা/উপকার গ্রহণ করা। যেমন: আড়ৎ মহাজন এ শর্তে ঋণ দিলো যে, সিজনে উৎপাদিত সকল ফসল তার কাছেই বিক্রি করতে হবে। অনুরূপ, ঋণগ্রহীতা তার জমিটি ঋণদাতার কাছে বিক্রি করবে, এমন শর্ত করে ঋণ দেওয়া। – এখানে অতিরিক্ত যে সুবিধাটি গ্রহণ করছে তা রিবাল করদ-এর অন্তুর্ভুক্ত।
৩. ট্রেডিশনাল ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত মুনাফা বা ইন্টারেস্ট। শরয়ী বিকল্প: ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহের রিবামুক্ত বিনিয়োগ পদ্ধতি। যেমন: মুদারাহা, মুশারাকা, সুকুক, সালাম, ইস্তিসনা, ইজারা ইত্যাদি মডিউল।
৪. বন্ড, প্রাইজ বন্ড, ট্রেজারি বিল। এগুলোও নিষিদ্ধ রিবার অন্তর্ভুক্ত। বন্ড, প্রাইজ বন্ড, ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে জনগণ বা কোম্পানী থেকে ঋণ অর্থ সংগ্রহ করা হয় এবং মেয়াদান্তে ঋণের ওপর অতিরিক্ত সুদ প্রদান করা হয় বিধায় এগুলো কুরআনে নিষিদ্ধ রিবার অন্তুর্ভুক্ত। শরয়ী বিকল্প: বন্ড, প্রাইজ বন্ড, ট্রেজারি বিল – এর শরীয়াসম্মত বিকল্প হলো সুকুক।
৫. সঞ্চয়পত্র।
রিবাদ দাইন এর পরিচিতি ও প্রয়োগিক ক্ষেত্র:
রিবাদ দাইন বলা হয়, ব্যক্তির জিম্মায় কোনো দায় আবশ্যক হওয়া এবং উক্ত দায়ের ওপর রিবা আরোপ করা। বলে রাখা ভালো, রিবাদ দাইন রিবাল করদের তুলনায় ব্যাপক ও বিসৃত। উপরন্তু রিবাল করদ রিবাদ দাইনের প্রকার তূল্য। রিবাদ দাইনের কিছু প্রসিদ্ধ প্রায়োগিক দিক তুলে ধরা হলো।
১. মাস শেষে ভাড়া পরিশোধ করতে হয়, এটি ভাড়াটিয়ার ওপর একটি দায়। দায় সাব্যস্ত হওয়ার পর ভাড়াদাতার সাথে এভাবে চুক্তি করা যে, ভাড়া পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত সময় দেওয়া হবে। এর বিপরীতে মূল ভাড়ার সাথে অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করতে হবে। – এটি রিবাদ দাইন এর অন্তুর্ভুক্ত হবে।
২. মাস শেষে স্কুলের বেতন পরিশোধ করতে হয়। সুতরাং মাস শেষ হওয়ার পর এটি ব্যক্তির ওপর সৃষ্ট দায় হিসেবে গণ্য হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলো যে, যথাসময়ে বেতন পরিশোধ না করলে বয়েকা বাবদ মূল বেতনের ওপর অতিরিক্ত ৫% জরিমানা দিতে হবে। – দায় সাব্যস্ত হওয়ার পর অতিরিক্ত জরিমানা প্রদানের শর্ত করাটা রিবাদ দাইনের (সুদ) অন্তুর্ভুক্ত।
৩. কাউকে জরিমানা গুনতে হলো এবং তা পরিশোধের জন্য ৩ মাস সময় বেঁধে দেওয়া হলো। এই জরিমানা ব্যক্তির ওপর একটি দায়। যেহেতু দায় সাব্যস্ত হয়েছে, কাজেই আরেপিত অর্থের ওপর অতিরিক্ত নেওয়া যাবে না, নিলে রিবাদ দাইন সাব্যস্ত হবে।
যদি জরিমানা দাতা জরিমানা গ্রহীতার সাথে সমোঝোতা করে যে, জরিমানা পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত ২ মাস সময় দেওয়া হবে এবং এর বিপরীতে মূল পাওনার সাথে আরো ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। তাহলে এটিও নিষিদ্ধ রিবার অন্তর্ভুক্ত হবে।
৪. বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল ইত্যাদি যথা সময়ে পরিশোধ না করলে বয়েকার ওপর অতিরিক্ত জরিমানা দেওয়াটাও রিবাদ দাইনের অন্তুর্ভুক্ত। একারণে রিবা থেকে বেঁচে থাকতে যথাসময়ে এসব বিল পরিশোধ করা আবশ্যক।
রিবাল হাদিসের পরিচিতি ও প্রকারভেদ:
হাদিসে যে রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাকে রিবাল হাদিস বলে। রিবাল হাদিসকে ‘রিবাল বুয়ু’ ও বলা হয়।
রিবাল হাদিস দুই প্রকার।
- রিবাল ফজল।
- রিবান নাসা।
রিবাল ফজল ও রিবান নাসা বোঝার জন্য পণ্যের দুটি গুনাগুণ সম্পর্কে জানা জরুরী। দুটি গুণ হলো,
১. বিনিময় ও পণ্য উভয়টি সমজাতীয় (একজাতীয়) হওয়া।
২. উভয়টি পরিমেয় হওয়া। অর্থাৎ বাটখারা বা পাত্রে পরিমেয় হওয়া। যেমন: গমের বিনিময়ে গম বিক্রি করা, ধানের বিনিময়ে ধান বিক্রি করা। – এখানে বিনিময় ও পণ্য উভয়টিতে দুটি গুণ অর্থাৎ এক জাতীয় হওয়া ও পরিমেয় হওয়া বিদ্যমান।
রিবাল ফজল এর পরিচিতি:
পণ্য ও বিনিময় উভয়টি একজাতীয় হওয়া এবং পরিমেয় হওয়া। – এ দুটি গুণ পাওয়া গেলে নগদে কম-বেশি করে বিক্রি করলে তাকে রিবাল ফজল করে।
রিবান নাসা এর পরিচিতি :
রিবান নাসা সাব্যস্ত হয় বাকিতে কৃত লেনদেনের ক্ষেত্রে। নগদে কৃত লেনদেনে রিবান নাসা সাব্যস্ত হয় না। বাকিতে কৃত লেনদেনে রিবান নাসা দুই ভাবে হতে পারে। যথা:
১. পণ্য ও বিনিময় উভয়টিতে পূর্বে বর্ণিত দুটি গুণাগুণ (একজাতীয় ও পরিমেয়) বিদ্যমান থাকবে। – যেহেতু উভয় গুণাগুণ বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই বাকিতে লেনদেন করলে রিবাল ফজলের পাশাপাশি রিবান নাসা সাব্যস্ত হবে। চাই বাকিতে কম-বেশি করে বিক্রি করা হোক বা সমান-সমান করে।
উদাহরণস্বরূপ: লবনের বিনিময়ে লবন বিক্রি করা।
- নগদে সমান সমান করে বিক্রি করলে রিবা নেই।
- নগদে কম-বেশি করে বিক্রি করলে রিবাল ফজল সাব্যস্ত হবে।
- বাকিতে সমান সমান করে বিক্রি করলে রিবান নাসা সাব্যস্ত হবে।
- বাকিতে কম-বেশি করে বিক্রি করলে রিবাল ফজল ও রিবান নাসা সাব্যস্ত হবে।
২. দুটি গুণের কোনো একটি গুণ বিদ্যমান থাকে। – এক্ষেত্রে নগদে কম-বেশি বিক্রি করা বৈধ। তবে বাকিতে বিক্রি করলে তা রিবান নাসা-এর অন্তুর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
যেমন: গমের বিনিময়ে ধান বিক্রি করা।
গুণাগন: | ধান: | গম: |
---|---|---|
সমজাতীয়/একজাতীয় | না | না |
পরিমেয় | হ্যাঁ | হ্যাঁ |
গম ও ধান এক জাতীয় নয়; বরং ভিন্ন জাতীয়। তবে উভয়টি পরিমেয় হওয়ার হওয়ার উভয়টিতে একটি গুণ বিদ্যমান রয়েছে। যেহেতু একটি গুণ বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই নগদে কম বেশি করে বিক্রি করা বৈধ। তবে, বাকিতে বিক্রি করা যাবে না। বাকিতে বিক্রি করলে তা রিবান নাসা হিসেবে গণ্য হবে।
রিবাল ফজল এর প্রয়োগিক দিক:
১. নগদে এক কেজি খেজুরের বিনিময়ে দুই কেজি খেজুর বিক্রি করা। এখানে পণ্য ও বিনিময় উভয়টি সমজাতীয়। আবার উভয়টি পরিমেয়। কাজেই এখানে কমবেশি করে লেনদেন করলে এটি রিবাল ফজলের অন্তুর্ভুক্ত হবে।
২. নগদে এক কেজি আমের বিনিময়ে দেড় কেজি আম বিক্রি করা।
৩. নগদে এক কেজি বাসমতি চালের বিনিময়ে তিন কেজি আটাশ চাল বিক্রি করা।
রিবান নাসা এর প্রয়োগিক দিক:
১. বাকিতে এক কেজি বাসমতি চালের বিনিময়ে এক কেজি বাসমতি চাল বিক্রি করা।
২. বাকিতে এক কেজি বাসমতি চালের বিনিময়ে দেড় বাসমতি চাল বিক্রি করা।
৩. বাকিতে আমের বিনিময়ে আঙ্গুর বিক্রি করা। চাই কম-বেশি হোক বা সমান সমান।
ইসলামে রিবা একটি নিষিদ্ধ ও ভয়াবহ অপরাধ। এই পোস্টে রিবাল কুরআন ও রিবাল হাদিস এর মাধ্যমে রিবার প্রকারভেদ, যেমন রিবার করদ, রিবাদ দাইন, রিবাল ফজল ও রিবান নাসা এবং সমাজে এর প্রয়োগিক দিকগুলো আলোচনা করা হয়েছে। রিবামুক্ত জীবনযাপন ও ইসলামি অর্থনীতির অনুসরণের মাধ্যমে আমরা সমাজে ন্যায়বিচার ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রিবা থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।