ইসলামী শরীয়ায় রিবা (সুদ) গ্রহণ ও প্রদান একটি ভয়াবহ অপরাধ ও কবীরা গোনাহ। এর ভয়াবহতা এতই ব্যাপক যে, শাস্তির বিচারে শিরকের পরবর্তী স্থান হলো রিবার। শিরক, মানব হত্যা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা ও যিনার মতো বড় গোনাহ থাকা সত্ত্বেও কেবল রিবার বিরুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে আয়াত নাজিল করেন।
রিবার পরিচিতি:
‘বিনিময়হীন অতিরিক্ত ভোগ’ কে রিবা বলে। আর অতিরিক্ত ভোগ মুদ্রা, পণ্য বা সার্ভিস হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ:
১. ঋণদাতা ঋণগ্রহীতাকে ১০ হাজার টাকা এ শর্তে দিল যে, পরিশোধের সময় অতিরিক্ত ৫০০ টাকা প্রদান করা। – এই অতিরিক্ত ৫০০ টাকা ‘বিনিময়হীন অতিরিক্ত ভোগ’ এর অন্তর্ভুক্ত।
২. এক মন ধান পরবর্তীতে দেড় মন ধান পরিশোধের শর্তে ঋণ দেওয়া। – এখানে অতিরিক্ত আধা মন ‘বিনিময়হীন অতিরিক্ত ভোগ’ এর অন্তর্ভুক্ত।
রিবা একটি পরিভাষা:
রিবা শব্দটি একটি পরিভাষা। পরিভাষা হওয়ার অর্থ হলো:
- এর আভিধানিক অর্থ উদ্দেশ্য যাবে না।
- নিজ থেকে এর ব্যাখ্যা করা যাবে না।
- শরীয়াহ ভাষ্য ও ফকীহদের মতামতের আলোকে এর ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ জেনে নিতে হবে।
বিজ্ঞগণ বলেন, কেউ যদি সালাত আদায় করতে চায় তাহলে তার জন্য সালাত আদায়ের পদ্ধতি শেখা আবশ্যক। অনুরূপ কেউ রিবা থেকে বাঁচতে চাইলে তার ‘রিবা’ সম্পর্কে জানা আবশ্যক। হযরত উমর রা. বলেন:
لا يتجر في سوقنا إلا من فقه وإلا أكل الربا
অর্থ: রিবা সম্পর্কে না জেনে কেউ যেন আমাদের বাজারে ব্যবসা করতে না আসে। অন্যথায় (অজ্ঞতাবশত) সে রিবায় জড়িয়ে পড়বে।
– আত তাহমীদ: খ.১, পৃ. ৫৪৬; – দারুল কুতুবিল ইসমিয়্যাহ। প্রকাশকাল: ১৯৯৯
সুদ ও রিবা কী একই?
কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত রিবার পরিধি ব্যাপক ও বিসৃত। প্রচলিত সুদ তার একটি প্রকার মাত্র। আমাদের সমাজে ইন্টারেস্ট বা সুদ বলতে কেবল ‘প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত গ্রহণ’ কে বোঝানো হয়। এ ছাড়াও রিবার আরো প্রকার রয়েছে।
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সুদ:
ইংরেজিতে সুদের দুটি প্রতিশব্দ রয়েছে। যথা: ক. Interest খ. Usury। প্রাপ্ত ইন্টারেস্টকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। যথা:
- মোট সুদ (Gross Interest)
- নিট সুদ (Net Interest)
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সুদ বলতে কেবল ‘নিট সুদ’ (Net Interest) কে বোঝানো হয়। আর ইসলামী শরীয়ায় নিট সুদ ও মোট সুদ উভয়টি রিবার অন্তর্ভুক্ত।
মোট সুদ ও নিট সুদের মাঝে পার্থক্য:
মোট সুদ (Gross Interest): ঋণ গ্রহীতা মূল ঋণের বিপরীতে যে অতিরিক্ত প্রদান করে তাকে মোট সুদ (Gross Interest) বলা হয়। এখানে ঋণ আদান-প্রদান জনিত ব্যয়, ব্যবস্থাপনার খরচ, ঝুঁকি গ্রহণের পারিতোষিক, সুদী কার্যক্রমে জড়িত কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকে।
নিট সুদ (Net Interest): প্রাপ্ত সুদ থেকে ঋণ ব্যবস্থাপনার খরচ, ঝুঁকি গ্রহণের পারিতোষিক, কর্মচারীদের বেতনসহ যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট যেটা থাকে সেটাকে নিট সুদ বলে।
আমাদের দেশে কেউ কেউ শুধু Cost of Fund কেই সুদ বলতে চান। ইসলামী শরয়ীয়ায় Cost of Fund, নিট সুদ, মোট সুদ – সবই নিষিদ্ধ রিবার অন্তর্ভুক্ত।
রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার দলিল:
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ۗ وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ۚ فَمَن جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىٰ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَنْ عَادَ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (275) يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ (276) إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (277) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ (278) فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ۖ وَإِن تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ.
অর্থ: ২৭৫. যারা সুদ খায় (কিয়ামতের দিন) তারা সেভাবেই ওঠবে যেমন ওঠে, শয়তান যাকে অপস্পর্শ দ্বারা অপ্রকৃতিস্থ করে দিয়েছে। ঐ সাজা এজন্য যে, তারা বলেছিল, বিক্রি তো সুদেরই মতো। অথচ (প্রকৃত বিষয় হলো,) আল্লাহ বিক্রিকে হালাল করেছেন, আর সুদকে হারাম করেছেন। তো যার কাছে তার রবের পক্ষ হতে উপদেশ এসেছে, অনন্তর (সুদের লেনদেন থেকে) সে বিরত থেকেছে তাহলে পিছনের লেনদেন তার অনুকূলে (ক্ষমাযোগ্য), পক্ষান্তরে তার (ভিতরের) অবস্থা আল্লাহর এখতিয়ারে অর্পিত। আর যে (আবার সুদের লেনদেন দিকে) ফিরে যাবে, ওরাই আছহাবে নার-জাহান্নামী। তাতে তারা চিরকাল থাকবে। ২৭৬. আল্লাহ তো সুদকে সংকুচিত/বিলুপ্ত করেন, আর দান-ছাদাকা বর্ধিত/সমৃদ্ধ করেন। বস্তুত আল্লাহ প্রত্যেক কৃতঘ্ন পাপিষ্ঠকে অপছন্দ করেন। ২৭৭. যারা ঈমান আনে এবং নেক আমলে মগ্ন থাকে, আর সালাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে তাদের রবের নিকট তাদের জন্য অতি অবশ্যই রয়েছে পূর্ণ প্রতিদান। আর (সেদিন) তাদের উপর কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না। ২৭৮. আয় আহলে ঈমান! (শোনো,) তোমরা আল্লাহকে সমীহ কর, আর সুদের যে অংশ (কারো কাছে পাওনা) রয়ে গিয়েছে, ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো। ২৭৯. তো যদি তোমরা (তা) না কর তাহলে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ হতে। পক্ষান্তরে যদি তোমরা (সুদের লেনদেন থেকে) তওবা কর তাহলে তোমাদের মূল পুঁজি তোমাদের জন্য নিরাপদ থাকবে; না তোমরা জুলুম করবে, আর না তোমরা মাজলুম হবে।
– [সূরা বাকারা: ২৭৫-২৭৯; বঙ্গানুবাদ: মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ (তরজুমানী: ৫৮-৫৯)]
উক্ত আয়াতসমূহে পাঁচ ধরনের শাস্তির কথা করা হয়েছে। যথা:
- التخبط – কেয়ামতের দিন সুদখোর পাগলের মতো করব থেকে উঠবে।
- المحق – দুনিয়ায় সুদখোরের সম্পদ মিটিয়ে দেওয়া হবে।
- الحرب – সুদখোরের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তার রাসুল সা. যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অথচ অন্য কোনো গোনাহের ব্যাপারে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। কাজেই এটি ভয়াবহ অপরাধ, যা যিনা-ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক হিসেবে গণ্য।
- الكفر – সুদকে যারা বৈধ মনে করবে তারা ঈমান থেকে বেড়িয়ে মুরতাদে পরিণত হবে।
- الخلود في النار – যারা সুদের নিষিদ্ধতা জানার পরেও তাতে জড়াতে তারা জাহান্নামে যাবে।
রিবা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে:
عن ابن مسعود قال: لعن رسول الله – صلى الله عليه وسلم- آكل الربا، وموكله وشاهديه وكاتبه.
অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. সুদগ্রহীতা, সুদদাতা এবং সাক্ষীদ্বয় ও এর লেখককে অভিশাপ দিয়েছেন।
– [জামে তিরমিজি: ১২০৬]
উপরিউক্ত হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, রাসুল সা. ৪ শ্রেণীর প্রতি লানত করেছেন। তারা হলো,
- সুদগ্রহীতা
- সুদদাতা।
– এই দুই শ্রেণীর লোক রিবার মূল শাস্তিতে অভিন্ন। তবে দ্বিতীয় প্রকারের তুলনায় প্রথম প্রকারের শাস্তি বেশি হবে। - সুদের সাক্ষী। (সুদী চুক্তি সংঘটিত হওয়ার পক্ষে সাক্ষী থাকা।)
- সুদের লেখক।
ইসলামী শরিয়তে রিবা হারাম ও বাতিল লেনদেন হিসেবে বিবেচিত। অবশ্য রিবার ফজলের বিধান হলো: তা দ্বারা লেনদেন ফাসেদ হয়, বাতিল নয়। সব গোনাহ। এ ব্যাপারে সকলেই একমত।
ইমাম নববী রহ. বলেন: রিবা হারাম ও কবীরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত নিয়ে মুসলমানগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। – শরহুল মুহাজ্জাব: ৯/৩৯১
ইসলামী অর্থনীতিতে রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার শরয়ী মাকাসিদ:
- অর্থনৈতিক জুলুম প্রতিহত করা।
- সম্পদের ভারসাম্য বণ্টন নিশ্চিত করা।
- আর্থিক লেনদেনে বিনিময়হীন প্রাপ্তি রোধ করা।
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা রিবা নিষিদ্ধ করেছেন। হাদিসেও এর নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত। রিবার শাস্তি অন্যান্য পাপের তুলনায় অধিক ভয়াবহ। সমাজে প্রচলিত সুদ বা ইন্টারেস্ট রিবার একটি প্রকার মাত্র। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রিবা থেকে পরিপূর্ণ বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।