রমজান মাস হলো রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস। এই মাসে মুমিনদের জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হয়। মুমিনদের অধিক পূণ্য হাসিল ও ক্ষমাপ্রাপ্তির অপার সুযোগ রয়েছে এ মাসে।
রমজানের বিশেষত্ব:
১. রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে পূর্ণ কুরআন নাজিল করেন এবং এ মাসেই রাসুল সা.-এর ওপর সর্ব প্রথম কুরআন নাজিল হয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ হিদায়াত এবং যা (খাছ) হিদায়াতের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীর ধারক এবং যা সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী।
– সূরা বাকারা ১৮৫, বঙ্গানুবাদ: মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ (তরজুমানী: ৩৪)
২. এ মাসে রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন:
“রমজান মাস শুরু হলে রহমতের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়।”
– সহীহ বুখারী, হাদীস ১০৭৯/২
৩. রমজানে প্রতিটি আমলের বহু গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন:
“… রমজান এলে তুমি উমরা কর। এ মাসের উমরা একটি হজ্জের সমান। ”
– সহীহ মুসলিম। হাদিস নং: ১২৫৬
রমজানে করণীয়:
রোজা রাখা: সুস্থ-সবল, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রমজানের রোজা রাখা ফরজ। এটি এ মাসের বিশেষ আমল।
সালাতুত তারাবীহ আদায় করা: রমজানে তারাবীর নামাজ আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ আমল। এর মাধ্যমে আল্লাহ নৈকট্য লাভ ও রমজানের প্রতিশ্রুত সওয়াব ও প্রতিদান পাওয়া যায়।
কুরআন তেলাওয়াত ও যিকির করা: রমযানে অধিক পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল, যা অধিক নেকী হাসিলে সহায়ক। সালাফগণ পুরো রমজানে অধিক কুরআন তেলাওয়াত ও যিকিরে মগ্ন থাকতেন।
দান-সদকা করা: নফল দান-সদকায় বিপদ কাটে। স্বল্প পরিমাণে হলেও নিয়মিত দান করা। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
“রাসূল সা. ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রমযানে তিনি আরো বেশী দানশীল হতেন, যখন জিবরাঈল আ. তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন। আর রমযানের প্রতি রাতেই জিবরাঈল আ. তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন রহমতের বাতাস থেকেও অধিক দানশীল।
– সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ০৬
অধিক নফল ইবাদত করা: রমজান মাসে নফল ইবাদতের প্রতি বিশেষ মনোনিবেশ করা কাম্য। এক্ষেত্রে ফরজ সালাতের পূর্বে ও পরে দুই-চার রাকাত নফল সালাত আদায়, তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করা যেতে পারে। তাছাড়া অন্যান্য নফল ইবাদত যেমন: চাশতের সালাত, ইশরাকের সালাত, কিয়ামুল লাইল করা যেতে পারে।
ইতিকাফ করা: শেষ দশকের মাসনূন ই’তিকাফ অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ আমল। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত,
“রাসুল সা. রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। ইন্তিকাল বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেন।”
– মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং: ৮৪৩৫
রোজার ফজিলত:
হাদীস শরীফে রোজাদারের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও প্রতিদানের কথা বিবৃত হয়েছে। সেগুলোর কয়েকটি তুলে ধরা হলো:
১. রোজা কিয়ামতের দিবসে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন:
“রোজা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। কাজেই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কুবল করুন। অতঃপর তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।”
– মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং: ৬৬২৬
২. রোজা জাহান্নামের আগুনের ঢাল ও দুর্গ। হযরত ওসমান বিন আবুল আস রা. থেকে বর্ণিত,
“রোজা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষাকবচ, যেমন তোমাদের কারো জন্য যুদ্ধের ঢাল।”
– মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং: ১৬২৭৮
৩. রোজাদারের জীবনের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন:
“যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাস সহকারে সওয়াবের আশায় রমযানের রোজা রাখে, আল্লাহ তায়ালা তার জীবনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’
-সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ঈমান, পরিচ্ছেদ নং: ২৭, প্রকাশনী: দারু ইবনে কাসীর।
রোজার আদবসমূহ:
পূর্ণ প্রাপ্তি, মহত্ন অনুধাবণ ও পূণ্য অর্জনে রোজার আদব রক্ষা করা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোজার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আদব হলো:
১. সর্বদা যিকির-আযকার, দোয়া ও কুরআন তেলাওয়াতে নিমগ্ন থাকা।
২. সকল প্রকার মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা। বিশেষত অন্যের ক্ষতি সাধন না করা।
৩. দৃষ্টি, কান ও জিহ্বাকে সর্ব প্রকার গোনাহের কাজ থেকে বিরত রাখা।
৪. মিথ্যা, গিবত, অশ্লীল কথাবার্তা থেকে দূরে থাকা।
৫. ক্রোধ সংবরণ করা।
রমজান মাস আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক অপার নেয়ামত; যা রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে আসে। এটি শুধু সিয়াম পালনের মাস নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া অর্জন, ধৈর্যচর্চা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক বিশেষ সুযোগ। এ মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে, প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয় এবং জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। তাই আমাদের উচিত রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যবান করে তোলা—নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, যিকির, দান-সদকা এবং অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে আত্মনিয়োগ করা।
রমজানের শিক্ষা আমাদের পুরো বছরের জন্য একটি আদর্শ জীবনযাত্রার দিকনির্দেশনা দেয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে যথাযথভাবে সিয়াম পালন করার তাওফিক দান করুন এবং এ মাসের বরকত আমাদের জীবনে পরিপূর্ণভাবে বর্ষিত করুন। আমিন।