উৎপাদন উপকরণ ও উৎপাদন সহায়ক দুটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় মুদ্রাকে একটি শক্তিশালী ‘উৎপাদন উপকরণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অপরদিকে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় মুদ্রাকে ‘উৎপাদন উপকরণ’ নয়; বরং ‘উৎপাদন সহায়ক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
উৎপাদন উপকরণ ও উৎপাদন সহায়ক-এর মাঝে পার্থক্য:
উৎপাদন উপকরণ ও উৎপাদন সহায়ক-এর মাঝে পার্থক্য হলো:
বিষয়: | উৎপাদন উপকরণ (ভূমি, মেশিনারিজ): | উৎপাদন সহায়ক (মুদ্রা/অর্থ): |
---|---|---|
উপকার বা লাভ: | উৎপাদন উপকরণে বস্তুর আপন অস্তিত্ব বহাল রেখেও উপকৃত হওয়া যায়। যেমন: জমি ভাড়া দিয়ে আয় করা যায়। মেশিন ব্যবহার করে উৎপাদন করা যায়। | মুদার আপন অস্তিত্ব বহাল রেখে উপকৃত হওয়া যায় না। মুদ্রা থেকে উপকার পেতে হলে তা খরচ করতে হয়। |
ব্যবহারে ক্ষতি বা মূল্য হ্রাস: | উৎপাদন উপকরণ ব্যবহারের ফলে তা পুরনো হয়, ক্ষয় হয় বা বাজারমূল্য কমে যায়। যেমন: মেশিনারিজ, ভূমি। | মুদ্রার বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যবহৃত হলেও তার নিজস্ব ভ্যালু নষ্ট হয় না। যেমন: ১০০০ টাকার একটি নোট ব্যবহারের ফলে তার ভ্যালু কমে ৯০০ টাকা হয়ে যায় না। |
ঝুঁকি (Risk) বহনের দায়িত্ব: | উৎপাদন উপকরণে বস্তু বা সম্পত্তির রিস্ক মালিক বহন করে। কাজেই কেউ যদি কোনো বস্তু বা সম্পদ ভাড়া নেয়, তাহলে সেটি নষ্ট হলে মালিক দায় বহন করেন। | অপরদিকে কেউ মুদ্রা ঋণ নিলে মুদ্রার পুরো দায়দায়িত্ব ঋণ গ্রহীতার উপর বর্তায়। মুদ্রা হারালে বা লোকসান হলে এর ঝুঁকি ঋণ গ্রহীতাকেই বহন করতে হয়। |
তাছাড়া প্রান্তিক মুদ্রানীতিতে মুদ্রাকে কেবল উৎপাদন সহায়ক হিসেবেই গণ্য করা হতো। প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদ, ইমাম হাসান বসরী রহ. তৎকালীন প্রচলিত মুদ্রার ব্যাপারে মন্তব্য করে বলেন:
بئس الرفيقان: الدينار والدرهم لا ينفعك حتى يفارقك.
অর্থ: “নির্দয় দুটি সঙ্গী অর্থাৎ দিনার-দিরহাম, যা বিয়োগ হওয়া পর্যন্ত তোমাকে উপকৃত করবে না।”
– সিয়ারু আলামিন নুবালা: খ.৫ পৃ. ৪৫৬
তিনি তার বক্তব্যে মুদ্রার অন্তর্নিহিত সৃষ্টির উদ্দেশ্য বোঝাতে চেয়েছেন। আর তা হলো:
- মুদ্রা কেবল বিনিময় মাধ্যম ও বস্তুর মূল্য পরিমাপক। মুদ্রার অন্তর্নিহিত সৃষ্টির উদ্দেশ্য এটিই।
- মুদ্রা নিজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ নয়।
মুদ্রা ও দ্রব্যের মাঝে তফাৎ:
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মুদ্রা ও দ্রব্যের মাঝে তফাৎ পরিলক্ষিত। নিম্নে তা ছক আকারে তুলে ধরা হলো,
মুদ্রা: | দ্রব্য: |
---|---|
মুদ্রা সরাসরি ভোগ করা যায় না; বরং তা দ্রব্য বা অন্য ভোগের মাধ্যম হয়। | দ্রব্য সরাসরি ভোগ করা যায়। |
মুদ্রা কেবলই বিনিময় মাধ্যম ও মূল্য নির্ধারক। | দ্রব্য বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। |
মুদ্রা সুনির্দিষ্ট হয় না। | দ্রব্য সুনির্দিষ্ট হয়। |
উৎপাদন উপকরণ ও উৎপাদন সহায়ক-এর মাঝে এবং মুদ্রা ও দ্রব্যের মাঝে পার্থক্য তুলে ধরা হলো। এতেই লুকিয়ে রয়েছে সুদ বৈধতার হাতিয়ার। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় মুদ্রাকে একটি শক্তিশালী ‘উৎপাদন উপকরণ’ হিসেবে বিবেচনা করে সুদের বৈধতা নিশ্চিত করা হয়েছে।

উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয় যে মুদ্রা ও দ্রব্য, এবং উৎপাদন উপকরণ ও উৎপাদন সহায়কের মাঝে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য বুঝতে পারলে সহজেই বোঝা যায়, কেন ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা সুদের মতো অন্যায্য প্রথাকে অস্বীকার করে এবং মুদ্রাকে শুধুমাত্র বিনিময়ের মাধ্যম ও মূল্য নির্ধারক হিসেবে গণ্য করে। পক্ষান্তরে, পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা মুদ্রাকে একটি উৎপাদন উপকরণ রূপে প্রতিষ্ঠা করে সুদকে অর্থনৈতিক প্রবাহের একটি স্বাভাবিক উপাদান হিসেবে তুলে ধরে। অথচ, প্রকৃতপক্ষে মুদ্রা নিজে কোনো সম্পদ সৃষ্টি করে না; বরং সম্পদ সৃষ্টির সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তাই একটি ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই অর্থনীতি গঠনের জন্য মুদ্রার প্রকৃত অবস্থান ও ভূমিকা সঠিকভাবে অনুধাবন করা জরুরি।