বিশ্ব নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায়ই কিছু লোক মিথ্যা নবী দাবি করেছিল। তারা রাসুল সা.-এর নবুয়াতকে অস্বীকার করে বসে। বিষয়টি শুধু পুরুষদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পুরুষদের পাশাপাশি একজন নারীও নিজেকে নবী হিসেবে দাবি করে বসে। রাসুল সা.-এর ইন্তেকালের পর মিথ্যা নবুওয়াত দাবিদারদের ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। যারা মিথ্যা নবুওয়াত দাবী করেছিল, তাদের মধ্যে মুসায়লামাতুল কাজ্জাব একজন।
মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের পরিচয়:
মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের ব্যাপারে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত রয়েছে, নবী কারীম সা.-এর জামানায় মুসায়লামাতুল কাজ্জাব আসলো এবং (সাহাবা কেরামের নিকট) বলতে লাগল, মুহাম্মাদ (সা.) যদি তাঁর পর আমাকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন, তাহলে আমি তাঁর অনুসরণ করব। তার স্বজাতির এক বিরাট বাহিনী সঙ্গে নিয়ে সে এসেছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর নিকট আসলেন। আর তার সাথী ছিলেন সাবিত ইবনে কায়েস ইবনে শাম্মাস রা.। রাসূলুল্লাহ সা.– এর হাতে খেজুরের একটি ডাল ছিল। তিনি সাথি দ্বারা বেষ্টিত মুসায়লামার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং বললেন, তুমি যদি আমার নিকট খেজুরের এই ডালটিও চাও, তবুও আমি তা তোমাকে দিবো না। তোমার সম্বন্ধে আল্লাহর যা ফায়সালা তা তুমি লঙ্ঘন করতে পারবেনা।
যদি তুমি কিছু দিন বেঁচেও থাক; তবুও আল্লাহ তোমাকে অবশ্যই ধ্বংস করে দিবেন। নিঃসন্দেহে তুমি ঐ ব্যক্তি যার সম্বন্ধে স্বপ্নে আমাকে সব কিছু দেখানো হয়েছে। (ইবনে আব্বাস রা. বলেন; আবু হুরায়রা রা. আমাকে জানিয়েছেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, (একদিন) আমি ঘুমিয়েছিলাম। স্বপ্নে দেখতে পেলাম আমার দু’হাতে সোনার দু’টি বালা শোভা পাচ্ছে। বালা দু’টি আমাকে ভাবিয়ে তুলল। স্বপ্নেই আমার নিকট ওহী এলো, আপনি ফুঁ দিন। আমি তাই করলাম। বালা দু’টি উড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা এভাবে করলাম, আমার পর দুজন কাজ্জাব (চরম মিথ্যাবাদী) আবির্ভূত হবে। এদের একজন আসওয়াদ আনসী, অপরজন ইয়ামামার বাসিন্দা মুসায়লামাতুল কাযযাব।
মুসায়লামাতুল কাজ্জাব রাসুল সা.-এর বরাবর লিখে পাঠিয়েছিল যে, আমি আপনার সঙ্গে নবুওয়াতে অংশীদার। অর্ধেক পৃথিবী আপনার, আর অর্ধেক পৃথিবী আমার । নবীজি তার উত্তরে লিখেছিলেন,
من محمد رسول الله الى مسيلمة الكذاب. أما بعد فان الأرض الله يورثها من يشاء من عباده والعاقبة للمتقين.
“আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের প্রতি। জেনে রাখো, গোটা পৃথিবী আল্লাহর। আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা কর্তৃত্ব দান করেন। খোদা ভীরুদের জন্য রয়েছে উত্তম পরিণাম।”
নবীজির ইন্তেকালের পর আরও অনেকেই নবুওয়াতের দাবি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ক্রমশ তাদের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে । তুলাইহা ইবনে খুয়াইলিদ মিথ্যা নবুওয়াতের দাবি করলে বনু গাতফান তাকে সাহায্য করে। উইয়াইনা ইবনে হিসন আল-ফাজারি ছিল তাদের সর্দার। একইভাবে ইয়ামানে আসওয়াদ আনাসি, ইয়ামামায় মুসায়লামা ইবনে হাবিব নবুওয়াত দাবি করে। নবুওয়াতের দাবি শুধু পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং নারীদের মধ্যেও নবী দাবি করে বসে। সাজাহ বিনতে হারেসা তামিমা নবুওয়াতের দাবি করে। আর আশআস ইবনে কায়েস তার নবুওয়াতকে সমর্থন জোগায়। পরবর্তীকালে সাজাহ তার ক্ষমতা শক্তিশালী করতে মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
মোটকথা, মিথ্যা নবুওয়াত দাবির ব্যাধি গোটা আরবকে গ্রাস করে ফেলে। সমস্যাটির লাগাম টেনে ধরা জরুরি ছিল বিধায় আবু বকর রা. এদিকে বিশেষ মনোযোগ দেন। তার নির্দেশে খালেদ ইবনে ওয়ালিদ রা. হিজরতের একাদশতম বছরে সাবেত ইবনে কায়েস আনসারিকে সঙ্গে নিয়ে মুহাজির ও আনসারদের সমন্বয়ে একটি বাহিনীসহ নবুওয়াত দাবিদারদের দমনে বের হন।
খালেদ ইবনে ওয়ালিদ সর্বপ্রথম তুলাইহা বাহিনীর উপর আক্রমণ করে তার অনুসারীদের হত্যা করেন। উইয়াইনা ইবনে হিসনসহ ৩০ জনকে বন্দী করে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। উয়াইনা মদিনায় এসে ইসলাম কবুল করেন। কিন্তু তুলাইহা শামে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে সে উজর পেশ করে দুটি কবিতা লিখে পাঠায়। সে ইসলাম নবায়ন করে মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
মুসায়লামাতুল কাজ্জাবকে প্রতিহত করার জন্য শুরাহবিল ইবনে হাসান রা.-কে পাঠানো হয়। তবে আক্রমণের আগেই খালেদ ইবনে ওয়ালিদকে শুরাহবিল ইবনে হাসান রা.-এর সাহায্যের জন্য পাঠানো হয়। মুসায়লামা তার অনুসারীদের নিয়ে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পরিচালনা করে। এতে মুসলমানদের বড় একটি অংশ শহীদ হন। যাদের মধ্যে বড় একটি সংখ্যা ছিল কুরআনের হাফেজ। পরিশেষে, মুসলমানদের বিজয় হয়। হযরত ওয়াহশি রা.-এর হাতে মুসায়লামা নিহত হয়। তার স্ত্রী মিথ্যা নবুওয়াত দাবিদার সাজাহ পালিয়ে বসরায় চলে যায়। এর কিছুদিন পর সে মৃত্যুবরণ করে।
এদিকে আসওয়াদ আনাসী নবীজির জীবদ্দশায়ই মিথ্যা নবুওয়াত দাবি করেছিল। আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর যুগে তার শক্তি-সামর্থ্য অনেকগুণ বেড়ে যায়। একদা সে নেশাগ্রস্ত ছিল। সে অবস্থায়ই কায়েস ইবনে মাগুহ রা. ও ফিরোজ দায়লামি রা. তাকে হত্যা করে।
আবু বকর রা.-এর যুগে মুরতাদদের দমন:
নবীজির ইন্তেকালের পর বহু আরব গোত্রপতি মুরতাদ হয়ে যায়। সকলেই নিজ নিজ এলাকার বাদশাহ বনে বসে । বাহরাইনে নোমান ইবনে মুনজির মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আম্মানে লাকিত ইবনে মালেক বিদ্রোহের ঝান্ডা তুলে ধরে। একইভাবে কিন্দায় বহু শাসকের আবির্ভাব ঘটে। ফলে নবুওয়াত দাবিদারদের দমন করার পর আবু বকর রা. তাদের প্রতি মনোযোগী হন। তিনি আলা ইবনে হাজরামি রা.-কে বাহরাইনে পাঠিয়ে নোমান ইবনে মুনজিরকে দমন করেন। অনুরূপ হুজায়ফা ইবনে মিহসান রা. লাকিত ইবনে মালেককে হত্যা করে আম্মান ভূমি পবিত্র করেন। এরপর তিনি জিয়াদ ইবনে লাবিদের মাধ্যমে কিন্দার রাষ্ট্রনায়কদের দমন করেন।
জাকাত অস্বীকারকারীদের সতর্কীকরণ:
নবুওয়াত দাবিদার ও মুরতাদ ছাড়াও তৃতীয় এক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল । যারা জাকাত আদায়ে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল । এরা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করলেও জাকাত আদায়ে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল। সে সময় হযরত উমর রা.-এর মতো কঠোর প্রাণ ব্যক্তিও আবু বকর রা.-কে বলছিলেন, “যারা তাওহিদ ও রিসালাতের স্বীকারোক্তি প্রদান করে কেবল মাত্র জাকাত অস্বীকার করে, কীভাবে আপনি তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধারণ করতে পারেন!” কিন্তু এই মতভিন্নতা আবু বকর রা.-এর দৃঢ়তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি।
তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “আল্লাহর শপথ! যারা আল্লাহর রাসুলকে বকরির একটি ছোট্ট বাচ্চা হলেও প্রদান করত, এখন সেটা দিতে অস্বীকার করলে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।”
সেই কঠোরতার ফলে সামান্য কিছু সতর্কীকরণের পরই লোকজন স্ব স্ব জাকাত নিয়ে খেলাফতের দরবারে উপস্থিত হয়। এরপর উমর রা.-ও আবু বকর রা.-এর সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়ার স্বীকৃতি দেন এবং এই সিদ্ধান্তের যথাযথতা বুঝতে পেরে আবু বকর রা.-এর প্রশংসা করেন।