প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্কা, বালেগা নারীর জরায়ু থেকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে স্বাভাবিকভাবে যে রক্তক্ষরণ হয় তাকে হায়েজ বলে। হায়েজকে বাংলায় মাসিক স্রাব, ঋতু স্রাব, রাজ স্রাব ইত্যাদি বলে। ইংরেজিতে বলা হয় Monthly Period, Menstruation, Menses ইত্যাদি।
মাসিক স্রাব-এর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মেয়াদ:
ইসলামী শরীয়া মোতাবেক মাসিক স্রাব-এর সর্বনিম্ন মেয়াদ তিন দিন আর সর্বোচ্চ মেয়াদ দশ দিন। হযরত আনাস রা. বলেন:
“ঋতু স্রাবের সর্বনিম্ন সময় তিন দিন আর সর্বোচ্চ সময় দশ দিন।” – সুনানে দারুকুতনী, হাদিস নং: ৮০৮
বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. বলেন:
“মাসিক স্রাবের সর্বোচ্চ সীমা দশ দিন।” – মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নং: ১১৫১
সুতরাং জরায়ু থেকে তিন দিনের কম রক্ত নির্গত হলে সেটি শরয়ী বিধানানুসারে হায়েজ বা মাসিক স্রাব হিসেবে গণ্য হবে না। বরং ইস্তিহাজা হিসেবে গণ্য হবে।
মাসিক স্রাব-এর বয়সসীমা:
হানাফী ফকীহদের মতে, সর্বনিম্ন ৯ বছর বয়সে মাসিক শুরু হতে পারে। আর তা ৫৫ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে (অগ্রগণ্য মত)।
মাসিক স্রাব হিসেবে বিবেচিত নয় যেসব রক্ত:
- জরায়ু ব্যতীত অন্য কোনো অঙ্গ থেকে নির্গত রক্ত। যেমন: পায়ু পথে নির্গত রক্ত।
- সর্বনিম্ন বয়সসীমার আগে নির্গত রক্ত। যেমন: ৯ বছর বয়সের আগে জরায়ু থেকে রক্ত।
- মাসিক শুরু হওয়ার পর ৩ দিনের কম সময়ে নির্গত রক্ত মাসিক স্রাব হিসেবে বিবেচিত হবে না।
- গর্ভাবস্থায় নির্গত রক্ত।
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
“গর্ভবতী নারী ঋতুমতী হন না। সুতরাং যদি সে রক্ত দেখে তাহলে যেন গোসল করে এবং নামাজ আদায় করে।”
-মুসনাদে দারেমী, হাদিস নং: ৯৬২
মাসিক স্রাব বন্ধ হওয়ার লক্ষণ:
মাসিক স্রাব বন্ধ হওয়ার লক্ষণ দুটি।
ক. মাসিক পরবর্তী সাদা স্রাব নির্গত হওয়া।
খ. মাসিক স্রাবের রক্ত শুকিয়ে যাওয়া।
মাসিক চলাকালীন সময়ে মহিলাদের নামাজের বিধান:
১. মহিলাদের মাসিক স্রাব চলাকালীন সময়ের সকল নামাজ রহিত হয়ে যায়। এ সমস্ত নামাজ কাযা করতে হয় না। হযরত আয়েশা রা. বলেন:
“যখন মাসিক স্রাব শুরু হবে তখন নামাজ ছেড়ে দিবে।” – সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ৩০৬
২. যে নামাজের ওয়াক্তে স্রাব বন্ধ হয়েছে, সে ওয়াক্তের শেষ সময় পর্যন্ত স্রাব নির্গত হলে ওই ওয়াক্তের নামাজ কাযা করতে হবে না।
৩. জরায়ু থেকে রক্ত নির্গত হওয়ার সাথে সাথে নামাজ ছেড়ে দিবে। স্রাব শুরু হওয়ার পর যদি তিন দিন তিন রাতের কম সময় নির্গত হয়, তাহলে তা মাসিক স্রাব হিসেবে গণ্য হবে না। কাজেই পরবর্তীতে ওই ওয়াক্তের নামাজগুলো কাযা করে নিতে হবে। অনুরূপ যদি দশ দিনের অতিরিক্ত রক্ত নির্গত হলে সেক্ষেত্রে:
– জীবনে প্রথমবার মাসিক হলে দশ দিন পরবর্তী সময়ের নামাজগুলো প্রতি ওয়াক্তে পবিত্র হয়ে আদায় করবে।
– প্রথমবার নয়, এমন নারীর মেয়াদের বাইরে যে কয়দিন রক্ত নির্গত হবে সেদিনগুলোর নামাজ কাযা করতে হবে।
৪. সুন্নত, নফল নামাজ চলাকালে মাসিক শুরু হলে নামাজ ছেড়ে দিবে এবং পরবর্তীতে সে নামাজ কাযা করতে হবে।
মাসিক চলাকালে রোজা ও ইতিকাফের বিধান:
১. মাসিক স্রাব চলাকালীন রোজা রাখা হারাম।
২. রোজা অবস্থায় মাসিক শুরু হলে উক্ত দিনের রোজা কাযা করতে হবে।
৩. নফল রোজা চলাকালীন সময়ে মাসিক শুরু হলে সেটিও কাযা করতে হবে।
৪. রমজানের রাতে মাসিক বন্ধ হলে, অতঃপর গোসল না করে সকাল করলে; যদি পূর্ব হতে রোজার নিয়ত থাকে তাহলে রোজা হবে।
৫. মাসিক স্রাবের কারণে কাফফারার রোজার ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে না। তবে মাসিক পরবর্তী সময়ে পবিত্র হওয়ার সাথে সাথে রোজা শুরু করতে হবে। বিলম্ব করা যাবে না।
৬. ইতিকাফরত নারীর মাসিক শুরু হলে করণীয় হলো, পবিত্র হওয়ার পর ছুটে যাওয়া দিনগুলোর ইতিকাফ রোজাসহ কাযা করতে হবে।
ঋতুমতী নারীর হজ ও ওমরার বিধান:
১. ঋতুমতী নারী মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে। তবে মসজিদুল হারাম বা অন্য কোনো মসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না।
২. ঋতুমতী নারী তাওয়াফ ছাড়া হজ ও ওমরার অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করতে পারবে।
৩. হজ্জের শুরুতে স্রাব শুরু হলে ইহরাম, সায়ী, আরাফায় অবস্থান, মক্কায় প্রবেশসহ সকল আমলের শুরুতে গোসল করা সুন্নত।
৫. তাওয়াফে কুদুম এর আগে স্রাব শুরু হলে তা আদায় করা রহিত হয়ে যাবে। তবে এ সময়ে তাওয়াফ করলে দম দিতে হবে।
৬. মাসিক চলাকালে তাওয়াফে জিয়ারত করা যাবে না।
৭. মাসিক স্রাবের কারণে বিদায় তাওয়াফ রহিত হয়ে যাবে।
ঋতুমতী নারীদের জন্য করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়সমূহ
১. মাসিক চলাকালে মসজিদে প্রবেশ করা নিষেধ। তবে ঈদগাহ, জানাজা আদায়ের স্থান, মাদ্রাসা ইত্যাদি স্থানে যেতে পারবে।
২. মাসিক চলাকালে কুরআন তেলাওয়াত করা যাবে না। তবে, কুরআনের দোয়া বিশিষ্ট আয়াতগুলো দোয়ার নিয়তে পড়া যাবে।
৩. মাসিক চলাকালে কুরআন শ্রবণ, অনুবাদ পাঠ, হাদিস শ্রবণ ও পাঠ করা যাবে।
৪. কুরআনের পৃষ্ঠা উল্টানোর জন্য পরিহিত জামার আঁচল বা আঙুল ব্যবহার করা যাবে না।
৫. গিলাফ সহকারে কুরআন স্পর্শ করা যাবে। গিলাফ ছাড়া স্পর্শ করা যাবে না।
৬. হাদিস, ফিকহসহ অন্যান্য দ্বীনি কিতাবাদি স্পর্শ করা যাবে। তবে যে স্থানে কুরআনের আয়াত লেখা রয়েছে সে স্থান স্পর্শ করা যাবে না।
৭. মাসিক চলাকালীন সময়ে সহবাস করা হারাম। এসময় স্ত্রীর নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত দেখা ও স্পর্শ করা অনুচিত। উপরিউক্ত অংশগুলো ছাড়া বাকি অঙ্গ স্পর্শ করা যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
ويسألونك عن المحيض. قل هو أذى فاعتزلوا النساء في المحيض ولا تقربوهن حتى يطهرن.
অর্থ: “আর তারা আপনাকে হায়য সম্পর্কে (ঐ সময়ের সহবাস সম্পর্কে) জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন, তা তো এক ‘কষ্টদায়ক অপবিত্রতা’। সুতরাং হায়যের সময় (সঙ্গম থেকে) নারীদের পৃথক রাখো। আর (সঙ্গমসূত্রে) তাদের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়।”
– সুরা বাকারা: ২২২, বঙ্গানুবাদ: মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ।
মাসিক স্রাব সংক্রান্ত অন্যান্য বিধান:
১. প্রাপ্ত বয়স্কা নারী তিন হায়েজ দ্বারা ইদ্দত পালন করবে। আর যে নারীর মাসিক হয় না সে নারী তিন মাস ইদ্দত পালন করবে।
২. তালাকে রজয়ী হলে তৃতীয় মাসিক শেষ হওয়ার সাথে সাথে স্বামীর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়া অধিকার রহিত হয়ে যাবে এবং স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ বৈধ হবে।
৩. ঋতুমতী নারী দাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে পারবে, কল্যাণকর কাজ করতে পারবে এবং করব জিয়ারত করতে পারবে।
৪. সহবাসের পর মাসিক শুরু হলে গোসল করা আবশ্যক নয়।
৫. মাসিক স্রাব কাপড়ের যে অংশ লাগবে, সে অংশ ধৌত করাই যথেষ্ট। পুরো কাপড় ধৌত করতে হবে না।
৬. এ সময় সাজসজ্জা করা যাবে।
৭. সুগন্ধিযুক্ত ন্যাপকিন ব্যবহার করা মুস্তাহাব।
৮. শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলে ঔষধ সেবন করে সাময়িকভাবে মাসিক বন্ধ করা যাবে। ইবনে উয়াইনা জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন,
“তিনি ইবনে উমর রা.-কে দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকা ঋতুমতী নারীর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। মহিলা হায়েজ বন্ধকারী ঔষধ সেবন করতে চায়। ইবনে উমর এতে কোনো আপত্তি করেননি। তিনি আরাক গাছের নির্যাস সেবনের পরামর্শ দিন।”
– মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক, হাদিস নং: ১২৬৬
এই প্রবন্ধে মাসিক স্রাব বা হায়েজ সংক্রান্ত শরয়ী বিধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী, মাসিক স্রাবের সর্বনিম্ন মেয়াদ তিন দিন এবং সর্বোচ্চ মেয়াদ দশ দিন। গর্ভাবস্থায় রক্ত স্রাব মাসিক স্রাব হিসেবে গণ্য হয় না। মাসিক চলাকালীন নামাজ ও রোজা নিষিদ্ধ, এবং এই সময় কুরআন তেলাওয়াত ও মসজিদে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ। শারীরিক ক্ষতি না হলে ঔষধের মাধ্যমে মাসিক স্রাব বন্ধ করা যেতে পারে। মাসিক স্রাবের সময় সহবাস করা হারাম। আল্লাহ তায়ালা মাসিককালীন সময়ে শরয়ী বিধি-নিষেধ মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন।