ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি মুসলমানদের আয়ত্তে আসে খলীফা উমর বিন খাত্তাব রা.-এর যুগে। মুসলমানগণ তাদের বিজয় ও ইনসাফের পতাকা উঁচু করে জয় করেন বহু এলাকা, বহু অঞ্চল ও দেশ। বিজয়ের ধারাবাহিকতায় বাইতুল মাকদিস মুসলমানদের আয়ত্তে আসে।
ইয়ারমুক বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তারা কিন্নাসরিন, জাভাকিয়া, জুমা, সারমিন, তোজি, কুরস, তিলগিরার, দালুক, রাইয়ান প্রভৃতি ছোট ছোট এলাকাগুলো খুব সহজেই জয় করে ফেলেন। ফিলিস্তিনের দায়িত্বে ছিলেন আমর ইবনে আস রা.। তিনি নাবলুস, লুদ, আমাওয়াস, বাইতে জিবরিন প্রভৃতি স্থানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ১৬ হিজরিতে বাইতুল মাকদিস অবরোধ করেন।
ইতিমধ্যে আবু উবায়দা রা.-ও যুদ্ধ শেষে তার সঙ্গে এসে মিলিত হন। বাইতুল মাকদিসের খ্রিষ্টানরা কিছুদিন মুসলমানদের প্রতিহত করার পর সন্ধির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। তারা প্রস্তর জন্য বলে, আপনাদের আমিরুল মুমিনিন নিজে এসে নিজ হাতে সন্ধিচুক্তি লিখুন। উমর রা.-এর কাছে সংবাদটি পৌঁছানো হলে তিনি শীর্ষ সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে মদিনায় আলি রা.-কে তার স্থলাভিষিক্ত সাব্যস্ত করে ১৬ হিজরির রজব মাসে মদিনা থেকে বাইতুল মাকদিস অভিমুখে রওনা হন।
বাইতুল মাকদিস সফর:
খলিফা উমর রা. অতি সাধারণ বেশভূষায় সফরে বের হন। জাবিয়া নামক স্থানে মুসলিম সেনাপতিগণ তাকে স্বাগত জানান। তিনি কিছুদিন সেখানে অবস্থান করে সন্ধিনামা চূড়ান্ত করেন। এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে বাইতুল মাকদিসে প্রবেশ করেন। প্রথমে মসজিদে গমন করেন। এরপর খ্রিষ্টানদের গির্জা প্রত্যক্ষ করেন । এরই মধ্যে নামাজের সময় হলে খ্রিষ্টানরা তাদের গির্জায় নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়।
কিন্তু তিনি আশঙ্কা করেন, যদি তিনি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগেই তাদের গির্জায় গিয়ে নামাজ আদায় করেন, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ একে দলিল বানাতে পারে এবং সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া ব্যতীতই গির্জা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে পারে; তাই তিনি বাইরেই নামাজ আদায় করেন। বাইতুল মাকদিস থেকে ফেরার সময় উমর রা. গোটা রাষ্ট্র সফর করেন। তিনি সীমান্তগুলো প্রত্যক্ষ করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। সবশেষে তিনি কল্যাণ ও সফলতার সঙ্গে মদিনায় ফিরে আসেন।
বিচ্ছিন্ন কতিপয় যুদ্ধ ও বিজয়:
বাইতুল মাকদিস বিজয়ের পর কয়েক জায়গায় বিচ্ছিন্ন কিছু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জাজিরা বাসীর (আপার মেসোপটেমিয়া) প্রচেষ্টা এবং রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সহযোগিতায় খ্রিষ্টানরা আবারও হিমস দখলের চেষ্টা কিন্তু সফল হতে পারেনি। ফিলিস্তিনের প্রদেশসমূহের মধ্যে কাইসারিয়া (সিজারিয়া) ছিল জনবসতিপূর্ণ ও চমৎকার একটি শহর। হিজরি ১৩ সাম আমর ইবনে আস রা. সেখানে চড়াও হন। হিজরি ১৮ সন পর্যন্ত ধারাবাহিক আক্রমণ সত্ত্বেও শহরটি জয় করা সম্ভব হয়নি।
অবশেষে ১৮ হিজরির শেষদিকে মুয়াবিয়া রা, এক ইহুদির সাহায্যে দুর্গটি কবজা করে পতাকা উড়িয়ে দেন। ১৬ হিজরিতে আবদুল্লাহ ইবনে মুগনিম জাজিরা অভিযান পরিচালনা করেন । এক মাস অবধি তিকরিত অবরোধ করে রাখেন। সেখানে ২৪ দফা হামলা চালান। অবশেষে এটিও মুসলমানদের অধীনে চলে আসে। অবশিষ্ট এলাকাগুলো ইয়াজ ইবনে গানম জয় করেন। একইভাবে ১৬ হিজরিতে মুগিরা ইবনে শুরা রা, খুজিস্তান আক্রমণ করেন।
১৭ হিজরিতে তাকে অপসারণ করে তার স্থানে আবু মুসা আশআরি রা.-কে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি নতুন যুদ্ধসামগ্রী নিয়ে হামলা চালান এবং আহওয়াজ, মুনাজির, সউস, রামহুরমুজ বিজয় করে খুজিস্তানের রাজধানী তুসতুর অভিমুখে যাত্রা করেন। এটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও দুর্ভেদ্য দুর্গঘেরা স্থান। তবে এক ব্যক্তির সহায়তায় মুসলমানগণ ভূগর্ভস্থ এক রাস্তা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে শহরটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। দুর্গপতি হুরমুজানকে গ্রেফতার করে মদিনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে। ৩১৯ উমর রা.- অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাকে মদিনায় বসবাসের অনুমতি দেন। ভাতা হিসেবে তার জন্য বার্ষিক ২ হাজার অর্থ বরাদ্দ করেন।
মিশর বিজয়:
আমর ইবনে আস রা. পীড়াপীড়ির মাধ্যমে উমর রা.-এর অনুমতি নিয়ে ৪ হাজার মুজাহিদের একটি বাহিনী সঙ্গে নিয়ে মিসর আক্রমণ করেন। তিনি ফর্মা, বালপাস, ওম্ম অনিন প্রভৃতি অঞ্চল জয় করে নেন। এরপর ফুসতাত দুর্গ অবরোধ করে উমর রা.-এর কাছে সাহায্যকারী বাহিনী প্রেরণের আবেদন জানান। উমর রা. ১০ হাজার সৈন্যসহ জুবাইর ইবনে আওয়াম, উবাদা ইবনে সামেত, মিকদাদ ইবনে উমর এবং সালামা ইবনে মুখল্লাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের পাঠিয়ে দেন।
আমর ইবনে আস রা, মর্যাদার বিবেচনায় জুবায়ের ইবনে আওয়াম রা. কে তাদের আমির নিযুক্ত করেন। জুবায়ের রা.-এর অসাধারণ বীরত্বে সাত মাস পর কেল্লাটি মুসলমানদের পদানত হয়। এরপর মুজাহিদগণ আলেকজান্দ্রিয়ায় গিয়ে উপনীত হন। কার নামক স্থানে ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানেও খ্রিষ্টানরা পরাজিত হয়। মু
মুসলমানগণ আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছে স্বস্তির নিশ্বাস নেন। অল্প কদিন অবরোধ শেষে এটিও পদানত করেন । উমর রা. এ বিজয়ের সুসংবাদ শুনে সেজদায় লুটিয়ে পড়েন। তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন।
আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের পর গোটা মিসরে মুসলমানদের কর্তৃত্ব কায়েম হয়ে যায়। বহু কিবতি সাগ্রহে ইসলাম গ্রহণ করে।