প্রাচীনকালে জ্ঞানবিজ্ঞান, সভ্যতা ততটা উন্নত ছিল না। গাছের পাতা, পশুর চামড়া, পাথর খোদাই করে মানুষ লিখতে অভ্যস্ত ছিল। সভ্যতার পাশাপাশি প্রযুক্তির আমূল পরিবর্তনে মানুষ খেজুর পাতা, পশুর চামড়ার পরিবর্তে কাগজে লেখতে শুরু করে। সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল মানুষকে আবদ্ধ রাখতে পারেনি। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ উদ্ধাবন করল কম্পিউটার, স্মার্টফোন সহ আর কত কি! হিসাব নিকাশ, প্রয়োজনীয় তথ্য, গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, ঘটনার বিবরণ মোবাইলে বা কম্পিউটারে লিখে সংরক্ষণ করতে লাগল।
ফন্ট কি?
কখনো কি ভেবেছেন! আমরা আমাদের স্মার্টফোনে বা কম্পিউটারে; নিজ হস্ত লিপির পরিবর্তে ডিজাইসে থাকা লিপি ব্যবহার করে কিবোর্ডের সাহায্যে টাইপ করি। প্রেসে বা অন্য কোথাও হস্ত লিপি ব্যবহারের প্রচলন নেই। দীর্ঘদিন আমাদের ডিভাইসে ব্যবহার করা লেখন শৈলীর সূচনা কিভাবে হলো? এর পিছনে কাদের অবদানই বা রয়েছে?
সহজভাবে বলতে গেলে, আমরা আমাদের মেবাইলে বা কম্পিউটারে যে লিপির সাহায্যে টাইপ করি; তাকে পরিভাষায় ফন্ট বলা হয়। প্রতিটি ফন্টে থাকে ভিন্ন ডিজাইনে; যা কোনো ভাষার সকল বর্ণ, সংখ্যা ও সিম্বলের সম্বলিত সমষ্টিকে বুঝায়।
বাংলা ফন্ট কাকে বলে?
নির্দিষ্ট ডিজাইনে বাংলা ভাষার সকল বর্ণ, সংখ্যা ও সিম্বলের সমষ্টিকে ‘বাংলা ফন্ট’ বলে।
প্রতিটি ফন্টের আকার-আকৃতি ও ডিজাইন ভিন্ন হওয়ায় আলাদা আলাদা নামে নামকরণ করা হয়। যেমন: আলিনুর আদর্শলিপি, বর্ণমালা, শরীফ শিশির, ইত্যাদি।
এ পর্যন্ত প্রকাশিত বাংলা ফন্টের সংখ্যা ৭০০ এর অধিক।
বাংলা ফন্ট তৈরির ইতিহাস:
১৭৭৮ সালের পূর্বে কোন বাংলা ফন্ট ছিল না। যন্ত্রে বাংলা হরফের জন্ম হয়েছে ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত হলহেডের ব্যাকরণ বইয়ের মাধ্যমে। সে সময় উইলকিনস নামক একজন ইংরেজ বাংলা হরফের নকশা তৈরি করেন এবং পঞ্চানন কর্মকার নামক এক বাঙ্গাল ছেনি কেটে সিসা দিয়ে বাংলা হরফ তৈরি করেন।
ছেনি কেটে সিসা দিয়ে বাংলা হরফ তৈরির প্রক্রিয়াটি মোটেও সহজ ছিল না। তাছাড়া সে সময়কার প্রযুক্তিও ততটা উন্নত ছিল না।
১৯৭৮ সালের পর থেকে ক্রমাগত বাংলা ফন্ট প্রকাশিত হতে থাকে। প্রযুক্তি উন্নত হওয়ার সাথে সাথে ফন্ট তৈরি প্রক্রিয়াটিও অনেকাংশে সহজ হয়েছে। পূর্বের তুলনায় বর্তমান ফন্ট গুলো সুন্দর ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
বাংলা ফন্ট তৈরির পক্রিয়া:
বাংলা টাইপফেস ডিজাইন এবং ফন্ট ডেভেলপ করার জন্য Fontcreator, Fontlab সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়। তবে, Adobe Illustrator, Inkscape বা এ জাতীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করে সাধারণত টাইপফেস তৈরি করা হয়।
অধিকাংশ ফন্ট Adobe Illustrator এ ডিজাইন করা হয়েছে। কেননা Illustrator এ বিভিন্ন টুলস ব্যবহার করে ফন্টকে খুব সহজেই আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। Fontlab বা Fontcreator এ সীমিত টুলস থাকায় বাংলা ফন্ট ডিজাইনের উপযোগী নয়। বরং এ সফটওয়্যারগুলো ফন্ট ডেভেলপমেন্টে ব্যবহৃত হয়।
প্রতিটি ফন্টে থাকে প্রায় ৩০০ এর অধিক স্বর বর্ণ, ব্যঞ্জন বর্ণ, যুক্তাক্ষর, অর্ধ যুক্তাক্ষর, সংখ্যা, সিম্বল সম্বলিত গ্লিফ। ডিজাইনারগণ সকল গ্লিফ ডিজাইন করে ডেভেলপের জন্য প্রস্তুত করেন।
ফন্ট ডেভেলপের পূর্বে ডিজাইনগত ক্রুটি সমাধান করতে হয়। ফন্ট ডেভেলপের কাজটি বেশ জটিল। প্রতিটি বর্ণের দূরত্ব, ‘ু, ূ, ৃ,ঁ’ সঠিক পজিশনে বসানো, ওপেনটাইপ ফিচার যুক্ত করে ফন্ট ডেভেলপের কাজ সমাপ্ত করতে দুই থেকে পাঁচ দিনের মতো সময়ের প্রয়োজন হয়। এভাবেই একটি ফন্ট ডেভেলপ করা হয়। সাধারণত ডিজাইনারগণ Adobe Illustrator বা এ জাতীয় সফটওয়্যার দিয়ে প্রতিটি অক্ষর আলাদা আলাদা ভাবে ডিজাইন করে থাকেন। অতঃপর fontlab বা এ জাতীয় সফটওয়্যার দিয়ে ফন্টটি ডেভেলপের কাজটি সম্পন্ন করে থাকেন।
বাংলা ফন্ট ফাউন্ড্রির তালিকা
বাংলা ফন্টকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ফন্ট ফাউন্ড্রি। এসকল ফন্ট ফাউন্ড্রি থেকে এ পর্যন্ত সাত শতের অধিক ফন্ট প্রকাশিত হয়েছে। সকল ওয়েবসাইট থেকে বাংলা ফন্ট সহজেই ডাউনলোড করতে পারেন:
ফন্টবিডি
লিপিঘর
অক্ষর ৫২
বেঙ্গল ফন্টস
ফন্টলিপি
ওমিক্রনল্যাব
টাইপোবাজ
নকশাকার
বাংলা ফন্ট নিয়ে জানা-অজানা তথ্য:
বাংলা ফন্ট নিয়ে জানা-অজানা বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হলো –
- সর্বপ্রথম কালার বাংলা ফন্ট তৈরি করেন এস. রাসেল।
- বাংলা বর্ণমালায় স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে সর্বমোট মাত্রাহীন বর্ণ সংখ্যা ১০টি।
- সর্বোচ্চ ওয়েট সম্পন্ন বাংলা ফন্টের নাম নোটো শেরিফ বাংলা।
- ANSI এর পূর্ণরূপ হচ্ছে: American National Standards Institute.
- Unicode এর পূর্ণরূপ হচ্ছে: Universal Character Encoding Standard.
- প্রথম যন্ত্রে বাংলা লিপির ব্যবহার করেন ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড।
- কোডপত্র ফন্ট জগতে আন্সি এবং ইউনিকোড এরপর নতুন এনকোডিং ‘বর্ণ’ নিয়ে আসে।
- লিপিঘর সর্বপ্রথম বাংলা ফন্টে মাত্রালতা ফিচার নিয়ে আসে।
- বিজয়, অভ্র ছাড়া বাংলা টাইপের জন্য রয়েছে বর্ণ কিবোর্ড – যা ব্যবহার করে বাংলা টাইপ করা যায়।
- সর্বাধিক বাংলা ফন্ট ডিজাইন করেছেন মুহা. আলিনুর ইসলাম। তার ডিজাইনকৃত ফন্টের সংখ্যা: ৭৪টি।