জান্নাত এমন আবাসস্থল, যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর অনুগত বান্দাদের বাসস্থান হিসেবে বানিয়েছেন এবং তা প্রস্তুত রেখেছেন পূত-পবিত্র বান্দাদের জন্য; যা কোনো চক্ষু কোনোদিন দেখেনি, কোন নাক তার বিবরণ শুনেনি এবং মানুষের অন্তর তা উপলব্ধি করেনি।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন: فَلَا تَعۡلَمُ نَفۡسٌ مَّاۤ اُخۡفِیَ لَهُمۡ مِّنۡ قُرَّۃِ اَعۡیُنٍ ۚ جَزَآءًۢ بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ
জান্নাত শব্দের অর্থ
জান্নাত শব্দের অর্থ হলো: বাগান। যেহেতু মুমিনের জান্নাত হবে সবুজ সমাহোরে ভরপুর। তাই জান্নাতকে জান্নাত বলা হয়। জান্নাত হলো পরকালে মুমিনদের আবাসস্থল। যাতে তারা সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করবে। যার প্রাসাদগুলো এমনভাবে তৈরি, একটি ইট হল স্বর্ণের, অপরটি রূপার; আস্তর হবে মেশকে আম্বরের; পাথর কুঁচিগুলো ইয়াকুত ও মণিমুক্তার; মাটি হবে জাফরানের।
তাতে এমন এক বৃক্ষ রয়েছে, যদি কোনো আরোহী শত বর্ষ ব্যাপী তার ছায়া প্রদক্ষিণ করে। তবুও তা অতিক্রম করতে পারবে না।
জান্নাতীদের স্তর:
জান্নাতে বসবাসকারীদের বিভিন্ন স্তর হবে। প্রতি স্তরের মাঝে ব্যবধান হবে আকাশ-জমিনের ব্যবধান। সর্বোৎকৃষ্ট জান্নাত হলো জান্নাতুল ফিরদাউস। যা থেকে জান্নাতের বিভিন্ন নহরগুলো প্রবাহিত হবে।
জান্নাতের নহরের বিবরণ:
জান্নাতে চার প্রকার নহর প্রবাহিত হবে। কোনটি স্বচ্ছ দুধের; কোনটি দুর্গন্ধহীন শরাবের; কোনোটি হবে মধুর আর কোনটি হবে মদের।
জান্নাতীদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য:
জান্নাতবাসীগণ হবেন পূর্ণিমার রাতে আলোকিত চাঁদের মত উজ্জ্বল। সেখানে তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দের কমতি থাকবে না। তারা সেখানে পছন্দসই ফল-ফলাদি ভক্ষণ করবে। তাদের পানীয় হবে আদা ও কর্পূর দ্বারা ছিপি যুক্ত।
তাদের বাত ক্রিয়ার প্রয়োজন হবে না। শরীরের ঘাম হবে সুগন্ধময়। ভেতর থেকে ঘ্রাণযুক্ত ঢেকুর বের হবে। যা তাদের বাত ক্রিয়ার প্রয়োজন মিটিয়ে দিবে।
তাদের খাবারের পাত্রগুলা স্বর্ণ-রূপার তৈরি। পরিধেয়গুলো হবে রেশমি কাপড়ের। স্বর্ণ ও মণি মুক্তার তৈরি চুড়ি হবে তাদের অলংকার।
প্রত্যেকের জন্য সেখানে হুরদের মধ্য থেকে দুইজন স্ত্রী থাকবে। যদি তাদের কেউ দুনিয়ায় এক বার উঁকি দিত। তাহলে পুরো দুনিয়া আলোকিত হয়ে যেত, আকাশ-জমিনের মধ্যবর্তী স্থানে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত, সে সূর্যের আলো নির্বাপিত হতো।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ یَوۡمَئِذٍ خَیۡرٌ مُّسۡتَقَرًّا وَّاَحۡسَنُ مَقِیۡلًا
সে দিন জান্নাতবাসীদের বাসস্থান হবে উৎকৃষ্ট এবং বিশ্রামস্থল হবে মনোরম।
[সুরা: আল ফুরকান – আয়াত নং: ২৪]
اُولٰٓئِکَ یُجۡزَوۡنَ الۡغُرۡفَۃَ بِمَا صَبَرُوۡا وَیُلَقَّوۡنَ فِیۡہَا تَحِیَّۃً وَّسَلٰمًا
এরাই তারা, যাদেরকে তাদের সবরের প্রতিদানে জান্নাতের সুউচ্চ প্রাসাদ দেওয়া হবে এবং সেখানে শুভেচ্ছা ও সালামের সাথে তাদের অভ্যর্থনা করা হবে।
[সুরা: আল ফুরকান – আয়াত নং: ৭৫]
জান্নাতের সর্বোৎকৃষ্ট নেয়ামত হলো আল্লাহ তায়ালার দীদার। আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর চির স্থায়ীভাবে সন্তুষ্টির ফায়সালা করবেন। মহান রবের দর্শন সর্বাপেক্ষা বড় নিয়ামত। যা অন্যান্য নিয়ামতগুলোকে ভুলিয়ে দিবে।
জান্নাত বিষয়ক আয়াত সমূহ:
কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের বিবরণ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَبَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ؕ کُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡہَا مِنۡ ثَمَرَۃٍ رِّزۡقًا ۙ قَالُوۡا ہٰذَا الَّذِیۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ وَاُتُوۡا بِہٖ مُتَشَابِہًا ؕ وَلَہُمۡ فِیۡہَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَہَّرَۃٌ ٭ۙ وَّہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ
যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদেরকে সুসংবাদ দিন যে, তাদের জন্য এমন সব বাগান (প্রস্তুত) রয়েছে, যার নিচে নহর প্রবাহিত থাকবে। যখনই তাদেরকে তা থেকে রিযক হিসেবে কোনও ফল দেওয়া হবে, তারা বলবে, এটা তো সেটাই, যা আমাদেরকে আগেও দেওয়া হয়েছিল। তাদেরকে এমন রিযকই দেওয়া হবে, যা দেখতে একই রকমের হবে। তাদের জন্য সেখানে থাকবে পুতঃপবিত্র স্ত্রী এবং তারা তাতে অনন্তকাল থাকবে।
[সূরা: আল বাকারা – আয়াত নং: ২৫]
وَقُلۡنَا یٰۤاٰدَمُ اسۡکُنۡ اَنۡتَ وَزَوۡجُکَ الۡجَنَّۃَ وَکُلَا مِنۡہَا رَغَدًا حَیۡثُ شِئۡتُمَا ۪ وَلَا تَقۡرَبَا ہٰذِہِ الشَّجَرَۃَ فَتَکُوۡنَا مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ
আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে থাক এবং এর যেখান থেকে ইচ্ছা প্রাণ ভরে খাও। কিন্তু ওই গাছের কাছেও যেও না। অন্যথায় তোমরা জালিমদের মধ্যে গণ্য হবে।
[সূরা: আল বাকারা – আয়াত নং: ৩৫]
وَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ۚ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ ٪
যেসব লোক ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারা জান্নাতবাসী। তারা সর্বদা সেখানে থাকবে।
[সূরা: আল বাকারা – আয়াত নং: ৮২]
اَمۡ حَسِبۡتُمۡ اَنۡ تَدۡخُلُوا الۡجَنَّۃَ وَلَمَّا یَاۡتِکُمۡ مَّثَلُ الَّذِیۡنَ خَلَوۡا مِنۡ قَبۡلِکُمۡ ؕ مَسَّتۡہُمُ الۡبَاۡسَآءُ وَالضَّرَّآءُ وَزُلۡزِلُوۡا حَتّٰی یَقُوۡلَ الرَّسُوۡلُ وَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَہٗ مَتٰی نَصۡرُ اللّٰہِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ نَصۡرَ اللّٰہِ قَرِیۡبٌ
(হে মুসলিমগণ!) তোমরা কি মনে করেছ, তোমরা জান্নাতে (এমনিতেই) প্রবেশ করবে, অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের উপর সেই রকম অবস্থা আসেনি, যেমনটা এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। তাদেরকে স্পর্শ করেছিল অর্থ-সংকট ও দুঃখ-কষ্ট এবং তাদেরকে করা হয়েছিল প্রকম্পিত, এমনকি রাসূল এবং তাঁর ঈমানদার সঙ্গীগণ বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? মনে রেখ, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।
[সূরা: আল বাকারা – আয়াত নং: ২১৪]
اَمۡ حَسِبۡتُمۡ اَنۡ تَدۡخُلُوا الۡجَنَّۃَ وَلَمَّا یَعۡلَمِ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ جٰہَدُوۡا مِنۡکُمۡ وَیَعۡلَمَ الصّٰبِرِیۡنَ
নাকি তোমরা মনে কর, তোমরা (এমনিতেই) জান্নাতে পৌঁছে যাবে, অথচ আল্লাহ এখনও পর্যন্ত তোমাদের মধ্য হতে সেই সকল লোককে যাচাই করে দেখেননি, যারা জিহাদ করবে এবং তাদেরকেও যাচাই করে দেখেননি, যারা অবিচল থাকবে।
[সূরা: আ-লু ইমরান – আয়াত নং: ১৪২]
وَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ سَنُدۡخِلُہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَبَدًا ؕ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقًّا ؕ وَمَنۡ اَصۡدَقُ مِنَ اللّٰہِ قِیۡلًا
আর যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদেরকে দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে ; আল্লাহ্ র প্রতিশ্রুতি সত্য, কে আল্লাহ্ অপেক্ষা কথায় অধিক সত্যবাদী ?
[সূরা: আন নিসা – আয়াত নং: ১২২]
وَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَا نُکَلِّفُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَہَاۤ ۫ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ۚ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ
আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে আর (মনে রাখতে হবে) আমি কারও প্রতি তার সাধ্যের বেশি ভার অর্পণ করি না, তারাই হবে জান্নাতবাসী। তারা তাতে সর্বদা থাকবে।
[সূরা: আল আ’রাফ – আয়াত নং: ৪২]
وَعَدَ اللّٰہُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَالۡمُؤۡمِنٰتِ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا وَمَسٰکِنَ طَیِّبَۃً فِیۡ جَنّٰتِ عَدۡنٍ ؕ وَرِضۡوَانٌ مِّنَ اللّٰہِ اَکۡبَرُ ؕ ذٰلِکَ ہُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ ٪
আল্লাহ মুমিন নর ও মুমিন নারীদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এমন উদ্যানরাজির, যার তলদেশে নহর বহমান থাকবে। তাতে তারা সর্বদা থাকবে এবং এমন উৎকৃষ্ট বাসস্থানের, যা রয়েছে সতত সজীব জান্নাতে। আর আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ, (যা জান্নাতবাসীগণ লাভ করবে)। এটাই মহা সাফল্য।
[সূরা: আত তাওবাহ্ – আয়াত নং: ৭২]
اِنَّ اللّٰہَ اشۡتَرٰی مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَنۡفُسَہُمۡ وَاَمۡوَالَہُمۡ بِاَنَّ لَہُمُ الۡجَنَّۃَ ؕ یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ فَیَقۡتُلُوۡنَ وَیُقۡتَلُوۡنَ ۟ وَعۡدًا عَلَیۡہِ حَقًّا فِی التَّوۡرٰىۃِ وَالۡاِنۡجِیۡلِ وَالۡقُرۡاٰنِ ؕ وَمَنۡ اَوۡفٰی بِعَہۡدِہٖ مِنَ اللّٰہِ فَاسۡتَبۡشِرُوۡا بِبَیۡعِکُمُ الَّذِیۡ بَایَعۡتُمۡ بِہٖ ؕ وَذٰلِکَ ہُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ
বস্তুত আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে-এর বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। ফলে হত্যা করে ও নিহতও হয়। এটা এক সত্য প্রতিশ্রুতি, যার দায়িত্ব আল্লাহ তাওরাত ও ইনজীলেও নিয়েছেন এবং কুরআনেও। আল্লাহ অপেক্ষা বেশি প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা আল্লাহর সঙ্গে যে সওদা করেছ, সেই সওদার জন্য তোমরা আনন্দিত হও এবং এটাই মহা সাফল্য।
[সূরা: আত তাওবাহ্ – আয়াত নং: ১১১]
*জান্নাত কাকে বলে এবং তার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বিবরণ প্রবন্ধটির ভাবধারা القراءة العرابية থেকে গৃহীত।