হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. ছিলেন রাসুল সা.-এর একজন নৈকট্যপ্রাপ্ত সাহাবী ও সমরে বিচক্ষণ যোদ্ধা। তিনি রাসুল সা.-এর মদিনায় হিজরতের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। জাহেলি যুগে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেন এবং ইসলাম গ্রহণের পরও বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. তার সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন প্রতিটি রণক্ষেত্রে। কাজেই এই মহামানবের জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো।
খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর পূর্ণাঙ্গ নাম ও বংশ পরিচয়:
নাম: খালেদ; উপনাম: আবু সুলাইমান; উপাধি: সাইফুল্লাহ। তার বংশধারা হলো: খালিদ বিন ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ইবনে মাখজুম আল-মাখজুমী। মায়ের নাম লুবাবা। তিনি উন্মুল মুমিনিন মাইমুনা রা.-এর নিকটাত্মীয় ছিলেন।
জাহেলি যুগে যুদ্ধ-বিগ্রহে নেতৃত্ব প্রদান এবং সেনা ছাউনি তৈরির দায়িত্ব খালেদ রা.-এর বংশের ছিল। ইসলাম আত্মপ্রকাশ করার পরও খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর উপর এই দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। এ কারণেই হুদাইবিয়া সন্ধির সময় কুরাইশদের পক্ষ থেকে যে প্রতিনিধি দল মুসলমানদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য এসেছিল, তাদের প্রধান হিসেবে ছিলেন হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.। উহুদযুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তিনি সামনের সারিতে থেকে লড়াই করেছেন। মক্কার মুশরিকরা ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর তার কৌশলের কারণে তারা পুনরায় একত্রিত হয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করেছিল।
খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর সন্তান-সন্ততি:
খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর কত জন সন্তান ছিল; সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। তবে দুইজন ছেলের নাম জানা যায়। একজন হলেন: মুহাজির; অপরজন হলেন: আবদুর রহমান। তাদের মধ্যে মুহাজির সিফফিন যুদ্ধে আলি রা.-এর সমর্থনে সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর শাসনামলে কনস্টান্টিনোপল অভিযানে অধিনায়কের দায়িত্ব পালনকারীদের মধ্যে আবদুর রহমান রহ. ছিলেন অন্যতম।
হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর ইসলাম গ্রহণ:
তিনি ষষ্ঠ থেকে অষ্টম হিজরির মাঝামাঝি সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। আমর ইবনুল আস রা. যখন ইসলাম গ্রহণের জন্য আবিসিনিয়া থেকে আরবে আসেন। পথিমধ্যে তিনি খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর সাক্ষাৎ পান। বাক বিনিময় হলে উভয়েরই বুঝতে পারেন; তারা একই উদ্দেশ্যে তারা মদিনায় গমন করছেন।
অতঃপর মদিনায় গমন করে তারা উভয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হোন। প্রথমে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা., এরপর আমর ইবনুল আস রা. ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর আমর ইবনুল আস রা. মক্কায় ফিরে আসেন এবং কিছুদিন সেখানে অবস্থান করে পুনরায় মদিনায় হিজরত করেন; কিন্তু খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রা. মক্কায় ফিরে না এসে মদিনাতেই বসবাস করতে থাকেন।
খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব:
যেহেতু খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রা.- এর যুদ্ধের ময়দানেই পুরো জীবন অতিবাহিত করেন, এজন্য নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্য থেকে সরাসরি উপকৃত হওয়ার সুযোগ কম হয়েছিল। এ কারণে তিনি বলতেন: জিহাদের ব্যস্ততা আমাকে কুরআন শিক্ষার বড় একটা অংশ থেকেই বঞ্চিত রেখেছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, জাবের ইবনে আবদুল্লাহ, মিকদাম ইবনে মাদি কারিব, কায়েস ইবনে আবু হাজেম, আশতার নাখয়ী, আলকামা ইবনে কায়েস, জুবায়ের ইবনে নুযাইর রহ. প্রমুখ তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণিত হাদিসগুলোর মধ্যে দুটি সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে বর্ণিত রয়েছে।
সাইফুল্লাহ উপাধি লাভ:
হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. ইসলাম গ্রহণ পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের পক্ষ হয়ে বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুতা যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও মুসলিম বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস হওয়া থেকে কৌশলে ফিরিয়ে আনার সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য রাসুল সা. হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. কে ‘সাইফুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর সমর কৌশল:
ইতিপূর্বে বলা হয়েছে; ইসলামের আবির্ভাবের সময় খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. সমর নেতা পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে স্বীয় পদে বহাল রাখেন। ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন যুদ্ধে রয়েছে তার বিরাট অবদান। যেভাবে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি মুসলমানদের কঠোর শত্রু ছিলেন, সেভাবে ইসলাম গ্রহণের পর তিনি মুশরিকদের শত্রুতে পরিণত হোন। কখনো এমন হতো; হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর ব্যাপারে শত্রুদল জানতে পেরে তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করত।
মৃত্যু:
খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. ২২ হিজরিতে দুনিয়া ছেড়ে পরপারের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তার জানাজায় হযরত উমর রা. অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার মৃত্যুতে মদিনার নারীদের উপর, বিশেষত বনু আজরায় শোকের ছায়া নেমে এসেছিল।