কুরবানি করা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। প্রতি বছর নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের জন্য নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে কুরবানি করা ওয়াজিব। কুরবানি করা ওয়াজিব, এমন ব্যক্তি কুরবানি না করলে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর পক্ষ থেকে তার উপর ধমকি এসেছে।
কুরবানির ফজিলত:
হাদিস শরীফে কুরবানীর বহু ফজিলত বর্ণিত রয়েছে। কিছু ফজিলত নিচে উল্লেখ করা হলো:
হযরত আয়িশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: কুরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করা (জবেহ করা) অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় মানুষের কোন আমল হয় না। কিয়ামতের দিন এর শিং লোম ও পায়ের খুর সব সহ উপস্থিত হবে। এর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায় সুতরাং স্বচ্ছন্দ হৃদয়ে তোমরা তা করবে। – ইবনে মাজাহ ১৪৯৩ [আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহ. (জামে’ তিরমিযী) হাদিস নং: ১৪৯৩ আন্তর্জাতিক নং: ১৪৯৩]
হযরত ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ কুরবানির দিন সম্পর্কে বলেছেন যে, এই দিন কোন মানুষ কুরবানির চেয়ে উত্তম কোন কাজ করতে পারে না। হ্যাঁ, তবে যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা হয়। [আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহ. (আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব) হাদিস নং: ১৬৬৮ ]
হযরত আলী (রা) সূত্রে নবি করীম (ﷺ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন: হে লোক সকল। তোমরা কুরবানি কর এবং এর রক্তের বিনিময়ে পুণ্য লাভের আশা রাখ। কেননা রক্ত যদিও মাটিতে পড়ে কিন্তু আসলে তা মহান আল্লাহর হিফাযতে চলে যায়। [আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহ. (আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব) হাদিস নং: ১৬৭০]
হযরত হুসাইন ইবনে আলী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি প্রফুল্ল মনে ও পুণ্য লাভের আশায় কুরবানি করবে, এ কুরবানি তার জন্য জাহান্নাম থেকে অন্তরায়স্বরূপ হয়ে যাবে। [আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহ. (আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব)
হাদিস নং: ১৬৭১ ]
হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ঈদের দিন কুরবানি করার খাতে যে অর্থ ব্যয় করা হয়, আল্লাহর নিকট অর্থ ব্যয়ের এর চেয়ে প্রিয় কোন খাত নেই। [আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহ. (আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব) হাদিস নং: ১৬৭২ ]
নিচে ধারাবাহিকভাবে কুরবানি সক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখান থেকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা-মাসায়েল জানতে পারবেন।
কুরবানির মাসআলা
কুরবানির রুকন কী?
নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের আশায় নির্দিষ্ট পশু জবেহ করা।
কুরবানি কার উপর ওয়াজিব:
মাসআলা: প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন, মুকিম, প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী; যে জিলহজ মাসে ১০ তারিখ ফরজ থেকে ১২ তারিখ মাগরিব পর্যন্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক হবে। তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। [আল মুহীতুল বুরহানী: ৬/৮৫; দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ]
নেসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক কী সারা বছর হতে হবে?
মাসআলা: কুরবানির নেসাব যাকাতের নেসাবের চেয়ে একটু আলাদা। কুরবানির নেসাবে পুরো বছর নেসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক হওয়া জরুরি না। বরং কুরবানির তিন দিনের যেকোনো একটি মালিক হলে তার উপর কুরবানি করা আবশ্যক। [বাদায়েউস সানায়ে: ৫/৬৩]
কুরবানির সময়সীমা:
মাসআলা: বছরে কুরবানির সময় হলো তিন দিন। অর্থাৎ, জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ। উল্লেখ্য যে, কুরবানির সময় শুরু হয়: জিলহজ্ব মাসে ১০ তারিখ সূর্যোদয়ের পর থেকে। এবং শেষ হয়: ১২ই জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত তা অবশিষ্ট থাকে। কেউ যদি এর আগে বা পরে পশু জবাই করে; তাহলে তার পক্ষ থেকে কুরবানি আদায় হবে না। [বাদায়েউস সানায়ে: ৫/৬৫]
কোন দিন কুরবানি করা উত্তম?
মাসআলা: প্রথম দিন তথা জিলহজ মাসের ১০ তারিখে কুরবানি করা উত্তম। এরপর দ্বিতীয় দিন। এরপর তৃতীয় দিন কুরবানি করা উত্তম। [কাজীখান ৩/২৩১; দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ]
কখন থেকে কুরবানির পশু জবাইয়ের সময় শুরু হয়?
মাসআলা: যে সকল স্থানে ইদ ও জুমার নামাজ আদায় হয়; সে সকল স্থানে ঈদের নামাজের আদায়ের পর থেকে কুরবানির পশু জবাইয়ের সময় শুরু হয়। কাজেই ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার পূর্বে কেউ যদি কুরবানির পশু জবাই করে; তাহলে তার কুরবানি আদায় হবে না। আর যে সকল স্থানে ইদ ও জুমার নামাজ আদায় হয় না; সে সকল স্থানে সূর্যোদয়ের পর থেকে কুরবানির পশু জবাইয়ের সময় শুরু হয়। [আল মুহীতুল বুরহানী: ৬/৮৮-৮৯; দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ]
কুরবানির পশু জবাইয়ের মুস্তাহাব সময় কখন থেকে শুরু হয়?
মাসআলা: ইদের নামাজের পর ইমাম সাহেবের খুতবা পাঠের পর থেকে কুরবানির পশু জবাইয়ের মুস্তাহাব সময় শুরু হয়। তবে সে সকল স্থানে ইদ ও জুমার নামাজ আদায় হয় না; সে সকল স্থানে সূর্যোদয়ের পর থেকে কুরবানির পশু জবাইয়ের মুস্তাহাব সময় শুরু হয়। [আল মুহীতুল বুরহানী: ৬/৮৯; দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ]
নাবালেগ বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুর উপর কুরবানি:
মাসআলা: নাবালেগ বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান নেসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক হলে তার উপর ওয়াজিব নয়। [কাযীখান: ৩/ ২৩১] কুরবানির সময়সীমার ভেতর যদি নাবালেগ বাগেল হয় এবং তার নেসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদ থাকে। তাহলে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব।
পাগলের উপর কুরবানি:
মাসআলা: পাগল ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হলেও তার কুরবানি করা আবশ্যক নয়। [কাজীখান ৩/২৩১; দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ]
মুসাফিরের জন্য কুরবানি করা বিধান:
মাসআলা: মুসাফির ব্যক্তির উপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয়। তবে যদি কুরবানির সময়সীমা অবশিষ্ট থাকতে মুসাফির মুকিম হলে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। অনুরূপভাবে যদি মুকিম ব্যক্তি কুরবানির সময়সীমায় মুসাফির হহলে তার উপর কুরবানি করা আবশ্যক নয়। [বাদায়েউস সানায়ে: ৫/৬৩]
দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানি করা কি আবশ্যক?
মাসআলা: সে ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ মালের মালিক নয়। তার উপর কুরবানি করা আবশ্যক নয়। [বাদায়েউস সানায়ে: ৫/৬৪]
কুরবানির দিনগুলোতে কুরবানি করতে না পারলে করণীয় কী?
মাসআলা: যদি কেউ কুরবানির সময়সীমাতে তার ওয়াজিব কুরবানি করতে না পারে। তাহলে যদি কুরবানি দাতা পশু ক্রয় করে থাকে তাহলে সেই পশুটি সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। আর যদি কুরবানির উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় করে না থাকে; তাহলে একটি ছাগলের মূল্য সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। [শরহু মুখতাসারুত ত্বহাবী ৭/৩৪১; দারুস সিরাজ]
মাসআলা: যদি কেউ ওয়াজিব কুরবানির পশু ক্রয় করার পর কোনো কারণবশত কুরবানি করতে না পারে। অতঃপর কুরবানির করার সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পশুটি জবাই করে; তাহলে মৃত পশুটি সদকা করে দিতে হবে এবং জবাইয়ের কারণে মূল্য যে পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে; সে পরিমাণ অর্থ সদকা করতে হবে। [শরহু মুখতাসারুত ত্বহাবী ৭/৩৪৩; দারুস সিরাজ]
যে সব পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে ও যাবে না
যে সব পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে
মাসআলা: মোট তিন প্রকার পশু দ্বারা কুরবানি দেওয়া যাবে। যথা: ১. উট ২. গরু ও মহিষ ৩. ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া। এগুলোর প্রত্যেক প্রকারের নর ও মাদি পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ। [আল-আসল: ৫/ ৪০৪]
খাসীকৃত পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে। [আল-আসল: ৫/ ৪০৫]
যে সব পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে না
মাসআলা: উট, গরু, মহিষ, ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া ছাড়া অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণী দ্বারা কুরবানি দেওয়া যাবে না। [আল-আসল: ৫/ ৪০৪]
মাসআলা: যদি বন্য পশু ও গৃহপালিত পশুর মিলনে বাচ্চা জন্ম নিলে মাদি পশুটি বিবেচ্য হবে। যদি মাদি পশুটি গৃহপালিত হয়; তাহলে কুরবানি করা বৈধ হবে। আর যদি মাদি পশুটি বন্য হয়; তাহলে কুরবানি করা যাবে না।
কুরবানির পশুর বয়সের সময়সীমা:
মাসআলা: কুরবানির পশুর বয়সের সময়সীমা হলো: উটের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫ বছর; গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ বছর; ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। তবে যদি দুম্বা ও ভেড়ার বয়স এক বছরের থেকে কমও হয়; তবে দেখতে এমন হৃষ্টপুষ্ট হয়, যা দেখতে এক বছরের মত দেখায়; তাহলে তা দিয়ে কুরবানি করা বৈধ। এক্ষেত্রে কমপক্ষে বয়স ৬ মাস হতে হবে। [আল মুহিতুল বুরহানী ৬/৯২]
উল্লেখ্য যে, ছাগলের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থানেই এক বছরের কম হলে তা কুরবানি করা বৈধ নয়।
কুরবানির পশুতে শরীকের সংখ্যা:
মাসআলা: ছাগল, ভেড়া ও দুম্বায় একজন কুরবানি দিতে পারবে। একাধিক ব্যক্তি কুরবানি দিতে কারো কুরবানি আদায় হবে না। গরু, মহিষ ও উটে সাত জন কুরবানি দিতে পারবে। [আসল: ৫/৪০৬]
মাসআলা: যদি গরু, মহিষ বা উটে সাতজনের চেয়ে বেশি তথা আটজন শরীক হয়। তাহলে কারো কুরবানি আদায় হবে না। সকলের পুনরায় কুরবানি দিতে হবে। [আসল: ৫/৪০৬]
মাসআলা: অনুরূপভাবে যদি দুইজন ব্যক্তি কুরবানি দেয়; যাদের একজন সাত ভাগ আর অপরজন এক ভাগ। অর্থাৎ মোট আট ভাগ। তাহলে কোনো শরীকের কুরবানি আদায় হবে না। উভয়ের কুরবানি পুনরায় দিতে হবে।
মোট কথা, যদি গরু, মহিষ বা উটে সাত ভাগের বেশি কুরবানি দিতে পারবে না। যদি সাত ভাগের বেশি দেওয়া হয়; তাহলে কোনো শরীকের কুরবানি আদায় হবে না।
গোশত খাওয়ার নিয়তে বা অমুসলিম কুরবানিতে শরীক হলে করণীয় কি?
মাসআলা: যদি কুরবানির পশুতে অর্থাৎ গরু অথবা উটে কোনো শরীক শুধু মাত্র গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানিতে শরীক হয়। তাহলে কুরবানি আদায় হবে না। [আসল: ৫/৪০৬]
অনুরূপভাবে যদি কুরবানির পশুতে অর্থাৎ গরু অথবা উটে কোনো শরীক অমুসলিম হয়। তাহলে কুরবানি আদায় হবে না। [আসল: ৫/৪০৬]
রুগ্ণ ও অসুস্থ পশু দিয়ে কুরবানি করার বিধান:
মাসআলা: যদি পশু এতটাই রুগ্ণ ও অসুস্থ হয় যে, কুরবানির স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না। তাহলে এমন পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ নেই। [আল মুহিতুল বুরহানী ৬/৯২]
দাঁত নেই এমন পশু দ্বারা কুরবানির বিধান:
মাসআলা: যদি পশুর এ পরিমাণ দাঁত থাকে; যা দিয়ে ঘাস চিবিয়ে খেতে পারে। এমন পশু দিয়ে কুরবানি করা জায়েজ। যদি দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে ঘাস চিবিয়ে খেতে না পাড়ে; তাহলে এমন পশু দ্বারা ওয়াজিব কুরবানি করলে কুরবানি আদায় হবে না। [আল মুহিতুল বুরহানী ৬/৯২]
শিং ভাঙ্গা পশু দ্বারা কুরবানি করার বিধান:
মাসআলা: যদি পশুর এ পরিমাণ শিং ভাঙ্গে; যার ফলে পশুর মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাহলে এমন পশু দ্বারা কুরবানি করা বৈধ নয়। আর যদি এ পরিমাণ শিং না ভাঙ্গে; তাহলে তা দিয়ে কুরবানি করা বৈধ। ফলে যদি কোনো পশুর শিং অর্ধেক বা তার থেকে কিছু কম ভেঙে থাকে বা একেবারেই শিং উঠেনি; এমন পশু দ্বারা কুরবানি করা বৈধ নয়।
লেজ ও কান কাটা পশু কুরবানি করার বিধান:
মাসআলা: যদি কোনো পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তার চেয়ে বেশী পরিমাণ কাটা থাকে; তাহলে এমন পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে না। যদি লেজ বা কোনো কান অর্ধেকের কম কাটা থাকে। তাহলে এমন পশু দ্বারা কুরবানি করা বৈধ। [আসল: ৫/৪০৯]
মাসআলা: কোনো পশুর যদি জন্মগতভাবে লেজ বা কান ছোট হয়; তাহলে সে পশু দিয়ে কুরবানি করা বৈধ। আর যদি জন্মগতভাবে লেজ ও কান না থাকে; তাহলে কুরবানি করা জায়েজ নেই। [আল মুহিতুল বুরহানী ৬/৯২]
অন্যের পক্ষ থেকে কুরবানি করার বিধান:
মুত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করার বিধান:
মাসআলা: যদি মৃত ব্যক্তি তার পক্ষ থেকে কুরবানি করার ব্যাপারে অসিয়ত করে যায়। যদি মৃত ব্যক্তির অর্থ সম্পদ থেকে কুরবানি করা হয়। তাহলে সেই কুরবানির গোশত সদকা করে দিতে হবে। আর যদি তা মৃত ব্যক্তির অর্থ সম্পদ থেকে কুরবানি না হয়; তাহলে সেই কুরবানির গোশত সকলেই খেতে পারবে।
বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য দেশে কুরবানি করার বিধান:
মাসআলা: বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তি দেশে কুরবানি করতে পারবে। যদি কুরবানি দাতা এক স্থানে থাকে আর কুরবানির পশু ভিন্ন স্থানে। তাহলে জবাই বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে কুরবানি দাতার নামাজ ধর্তব্য হবে না। বরং কুরবানির পশু যে স্থানে রয়েছে; সে স্থানের নামাজ ধর্তব্য হবে।
উল্লেখ্য যে, যদি কুরবানি দাতা এমন স্থানে অবস্থান করে, যেখানে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হয়নি। আর কুরবানির পশুটি এমন স্থানে রয়েছে; যেখানে সেখানকার স্থানীয়দের কুরবানির সময় হয়েছে। তাহলে কুরবানি দাতার উপর কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পশু জবাই করা যাবে না। জবাই করলে কুরবানি আদায় হবে না।
কুরবানির গোশত ও চামড়া দ্বারা পারিশ্রমিক প্রদান:
মাসআলা: কুরবানির গোশত, চর্বি ও চামড়া দ্বারা পারিশ্রমিক প্রদান করা জায়েজ নেই। কুরবানির পশুতে শরীক কেউ পশু জবাই করলে জবাইকারীর পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েজ নেই। তবে পশুতে শরীক নয়; এমন ব্যক্তি জবাই করলে জবাইয়ের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারবে।
কুরবানির পশুর হাড় বিক্রি:
মাসআলা: কুরবানিদাতার কুরবানির পশুর হাড় বিক্রয় করা জায়েজ নেই। যদি বিক্রি করে; তাহলে এর মূল্য সদকা করে দিতে হবে। তবে, দরিদ্র ব্যক্তির সদকা হিসেবে পাওয়া পশুর হাঁড় ও গোশত বিক্রি করতে অসুবিধে নেই।
জবাই করার পূর্বে কুরবারী দাতাদের নাম উচ্চারণ করা কি আবশ্যক?
মাসআলা: আমাদের দেশে একটি বিষয় লোক সমাজে প্রচলিত রয়েছে; আর তা হলো কুরবানির পশু জবাইয়ের পূর্বে কুরবানি দাতাদের নাম উল্লেখ করা হয়। এটা আবশ্যক কিছু না। এভাবে কুরবানি দাতাদের নাম উল্লেখ না করলে কোনো অসুবিধে নেই। [আসল: ৫/৪০৬]
যদি কেউ কুরবানির পশু ক্রয় করে বিক্রি তরে দেয়; তাহলে তার করণীয় কী?
মাসআলা: কেউ যদি তার ওয়াজিব কুরবানির পশু ক্রয় করার পর বিক্রি করে দেয়। তাহলে কুরবানির দিন অবশিষ্ট থাকলে আরেকটি পশু ক্রয় করে কুরবানি দিতে হবে। যদি দ্বিতীয় পশুটির মূল্য প্রথম পশুর থেকে কম হয়। তাহলে পার্থক্য পরিমাণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। [আসল: ৫/৪০৮]
কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি:
মাসআলা: কুরবানির পর কুরবানির পশুর চামড়া দ্বারা কুরবানি দাতা নিজে উপকৃত হবে পারবে। যেমন: চামড়া দ্বারা ব্যাগ, জুতা ইত্যাদি বানিয়ে ব্যবহার করতে পারবে। অনুরূপভাবে অন্যকে চামড়া উপহার দিতে পারবে।
তবে, যদি কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে দেয়; তাহলে তার মূল্য সদকা করে দিতে হবে। [আসল: ৫/৪০৮]
কুরবানির পশু হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে করণীয়:
মাসআলা: যদি কুরবানির পশু কেনার পর হারিয়ে যায় অথবা কেনার পর মারা যায় বা চুরি হয়; তাহলে ওয়াজিব কুরবানির জন্য নতুন পশু ক্রয় করে কুরবানি দিতে হবে। [আসল: ৫/৪১০]
পিতার জন্য সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানি করা আবশ্যক?
মাসআলা: পূর্বে বলা হয়েছে, শিশুর পক্ষ থেকে পিতার জন্য কুরবানি করা আবশ্যক নয়। যদিও শিশু নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়। অনুরূপভাবে পিতার উপর প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানি করা আবশ্যক নয়। যদি সন্তান নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়; তাহলে তার নিজের পক্ষ থেকে কুরবানি আদায় করতে হবে। [মাবসুত: ১২/১৪]
স্বামীর উপর কী স্ত্রীর পক্ষ থেকে কুরবানি করা আবশ্যক?
মাসআলা: যদি স্ত্রীর নেসাব পরিমাণ স্বর্ণ, রূপা বা সমপরিমাণ সম্পদ থাকে। তাহলে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীর জন্য কুরবানি করা আবশ্যক নয়। বরং স্ত্রী স্বীয় সম্পদ থেকে তার ওয়াজিব কুরবানি আদায় করবে। [মাবসুত: ১২/১৪]
একই পশুতে একাধিক নিয়তে শরীক হলে:
মাসআলা: যদি একই পশুতে কেউ কুরবানির, কেউ তামাত্তু হজের হাদীর, কেউ কিরান হজের হাদীর, কেউ নফল কুরবানির এবং কেউ সন্তানের আকীকার নিয়ত করে। তাহলে কুরবানি আদায় হয়ে যাবে। [কাজী খান: ৩/২৩৭]
ত্রুটিযুক্ত পশু কুরবানির বিধান কি?
ওয়াজিব কুরবানির ক্ষেত্রে ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানি দিলে কুরবানি আদায় হবে না।
উল্লেখ্য যে,
১. কুরবানির পশুর ক্ষেত্রে লেজ, কান জন্মগতভাবে না থাকা।
২. লেজ, এক শিং বা এক কান অর্ধেক তা অর্ধেকের চেয়ে বেশি কাটা থাকা।
৩. এক চোখ পুরোপুরি অন্ধ হওয়া; চার পায়ের কোনো এক পা এমন ত্রুটি যুক্ত হওয়া; যার ফলে উক্ত পায়ে ভর করে জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত যেতে পারে না।
কুরবানির পশুর পেট থেকে জীবিত বাচ্চা বের হলে করণীয় কী?
মাসআলা: যদি জবাইয়ের পূর্বে পশুর পেট থেকে জীবিত বাচ্চা বের হয়। তাহলে বাচ্চাটিও জবাই করতে হবে এবং এর গোশত সদকা করে দিতে হবে। [কাজী খান: ৩/২৩৬] আর যদি কুরবানির পশু জবাই করার পর পেট থেকে জীবিত বাচ্চা বের হয়। তাহলে জবাই করে এর গোশত খেতে পারবে।
একাধিক পশু কুরবানি করলে কয়টা কুরবানি আদায় হবে?
মাসআলা: যদি কেউ নিজের পক্ষ থেকে একাধিক পশু কুরবানি দেয়; তাহলে প্রথম পশু কুরবানির দ্বারা তার পক্ষ থেকে ওয়াজিব কুরবানি আদায় হয়ে যাবে আর অবশিষ্ট পশুগুলো নফল হিসেবে আদায় হবে। [আল মুহিতুল বুরহানী: ৬/১০১]
অমুসলিমদের উপর কুরবানির বিধান:
মাসআলা: কুরবানি একটি বিশেষ ইবাদত যা মুসলমানদের সাথেই বিশেষ। কাজেই অমুসলিমদের উপর কুরবানি করা আবশ্যক নয়। তবে যদি কোনো অমুসলিম কুরবানির সময়সীমার ভেতর ইসলাম গ্রহণ করে এবং সে নেসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক হয়। তাহলে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। [বাদায়েউস সানায়ে: ৫/৬৩]
জবাইয়ের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলার বিধান কি?
মাসআলা: পশু জবাইয়ের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলা জবাই শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত। কাজেই কেউ যদি জবাইয়ের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ‘বিসমিল্লাহ’ করা পরিহার করে; তাহলে সে পশু দ্বারা কুরবানি আদায় হবে না। পশু জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করলে অংশগ্রহণকারী সকলকেই ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে হবে। যদি জবাইয়ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কেউ ইচ্ছাকৃত ‘বিসমিল্লাহ’ না বলে; তাহলে জবাই শুদ্ধ হবে না এবং কুরবানি আদায় হবে না।
উল্লেখ্য যে, ছাগলের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থানেই এক বছরের কম হলে তা কুরবানি করা বৈধ নয়।
কুরবানীর মাসায়েল সংক্রান্ত PDF ফাইলটি ডাউনলোড করতে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করুন।
শেষ কথা,
উপরে কুরবানী সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ন মাসআলা-মাসায়েল এবং ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তালা আমাদেরকে উক্ত মাসআলাগুলোর উপর আমল করার তওফিক দান করুন। আমীন।