বদরের দিন কুরাইশদের সাথে যা ঘটেছিল তা তারা ভুলতে পারেনি। তারা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইল। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্য একটি বিশাল বাহিনী রাসুল সা. ও তার সাথীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তৃতীয় হিজরির হওয়ার ১৫ই শাওয়াল বের হলো। এটিই ছিল উহুদ যুদ্ধের কারণ।
উহুদ যুদ্ধ:
যখন মুসলমানগণ এ বিষয়টি আঁচ করতে পারলেন তখন তারা মদিনার বাইরে ঘিরে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর কাছে পিড়াপীড়ি করতে থাকেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. তাদের সাথে একমত হলেন। যদিও রাসুল সা. এর ইচ্ছে ছিল যে, মুসলমানগণ মদিনায় অবস্থান করবেন। সর্বপ্রথম আক্রমণ কাফেররাই করবে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. এক হাজার যোদ্ধা নিয়ে কুরাইশদের মোকাবেলায় উহুদ প্রান্তরে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে মুনাফিকদের মধ্যে একটি বৃহৎ সংখ্যা পালিয়ে যায়। ফলে মুসলমান সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা দিয়ে দাঁড়ায় ৭০০ এর কোটায়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. তাদেরকে পাহাড়ের দিকে পিঠ এবং মদিনার দিকে মুখোমুখি করে দাঁড় করান।
উহুদ যুদ্ধে পাহাড়ে হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইরের নেতৃত্বে ছোট্ট একটি প্রতিনিধি দল নিযুক্ত করেন। যাদের সংখ্যা ছিল ৭০ জন। তাদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. বলেন: যুদ্ধের জয়-পরাজয় যাই ঘটুক। আমার আদেশের পূর্বে তোমার কেউ এ স্থান ত্যাগ করবে না।
উহুদ প্রন্তরে রক্তক্ষয়ী লড়াই:
মুমিন ও মসজিদ দুইদলের মাঝে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধের সূচনায় বিজয় মুসলমানদের ছিল। মুশরিক বাহিনী ময়দান থেকে পলায়ন করলো। মুশরিক পুরুষ, নারী; দাস-দাসী সকলেই পলায়ন করল। আত্মরক্ষার জন্য মুশরিক নারীরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে লাগল।
পাহাড়ের উপর নিযুক্ত মুসলমান তিরন্দাজ বাহিনী যখন বিষয়টি লক্ষ্য করলো, তারা তাদের স্থান ছেড়ে দিয়ে গনিমত সংগ্রহ হয়ে নিচে অবতরণ করল। তাদেরকে নিচে অবতরণ হতে আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রা. নিষেধ করেন। তবুও তারা তার আদেশ লঙ্ঘন করে নিচে অবতরণ করেন।
খালেদ বিন ওয়ালিদ রা. কৌশল অবলম্বন:
খালেদ বিন ওয়ালিদ রা. তখনও মুসলমান হননি। উহুদ যুদ্ধে তিনি ছিলেন কাফের অশ্বারোহী বাহিনীর সর্দার। খালেদ বিন ওয়ালিদ সুযোগটিকে কাজে লাগান। তিনি পাহাড়ে থাকা অবশিষ্ট তিরন্দাজ বাহিনীকে হত্যা করেন। তাদের সংখ্যা ছিল ১০ জন। তারপর ত্বরিত গতিতে মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ের এবং মুশরিকদেরকে সারিবদ্ধ করে ফেলেন।
হঠাৎ আক্রমণের ফলে মুসলিম বাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তাদের মধ্য থেকে বৃহৎ একটি সংখ্যা শহীদ হয়ে গেল; যাদের মধ্যে ছিলেন হযরত হামজা রা. ও মুসআব রা.। মুশরিকরা প্রচার করতে লাগলো যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই কুরাইশরা জানতে পারলো যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত আছেন। কুরাইশদের যে বিজয় লাভ হয়েছে এতটুকুতেই তারা ক্ষ্যান্ত থাকলো। মুসলমানদেরকে রেখে তারা মক্কায় ফিরে গেল।
মুসলমান সৈন্যবাহিনী মদিনায় ফিরে এলো। রাতভর তারা মদিনার প্রবেশ পথগুলোতে পাহারাদারি করল। ফজরের নামাজ আদায়ের পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম দ্বিতীয়বার যুদ্ধে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. তাদের নিয়ে বের হলেন এবং ‘হামরাউল আসাদ’ নামক স্থানে শিবির গাড়লেন। যখন কুরাইশরা বিষয়টি জানতে পারলো তাদের অন্তরে ভয় ঢুকে গেল এবং তারা মক্কার দিকে পলায়ন করলো।
উহুদ কোথায় অবস্থিত এবং যুদ্ধের নামকরণের কারণ:
বনু নাযীর যুদ্ধ
চতুর্থ হিজরিতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বনু নাযীর গোত্রের ইহুদীদের নিকট গমন করেন; আমর ইবনে উমাইয়া যে দুই ব্যক্তিকে হত্যা করেছে; যেন তারা তাকে সে দিয়ত আদায়ে সাহায্য করে। আমর ইবনে উমাইয়া তাদেরকে শত্রু মনে করে হত্যা করেছিল অথচ সে দুই ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নিকট অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল।
বনু নাযীরের ইহুদিদের ষড়যন্ত্র
বনু নাযীরের ইহুদিরা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে বলল: হে আবুল কাসেম! আপনি যা ভাল মনে করেন, আমরা তাই করবো। তবে তারা তাদের অন্তরে একটি বড় দুরভিসন্ধি গোপন করে রেখেছিল আর তা হলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে গৃহে বসা ছিলেন, তাদের একজন বড় একটি পাথর নিয়ে সেই গৃহের ছাদে গোপনে উঠলো এবং সে তা উপর থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর উপর ফেলে দিতে চাইল।
তখনই জিব্রাইল আলাইহিস সাল্লাম রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করলেন। তিনি ইহুদিদের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে তাদেরকে জানিয়ে দিলেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কাল বিলম্ব না করেই প্রয়োজনের ভান করে বেরিয়ে যান এবং মদিনার দিকে রওনা হন। তিনি সাহাবায়ে কেরামদেরকে একত্রিত করেন।
বনু নাযীরের ইহুদিদেরকে অবরোধ
সাহাবায়ে কেরাম একত্রিত করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাদেরকে বলেন: বনু নাযীরের ইহুদিরা আমার সাথে গাদ্দারি করতে চেয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা আমাকে এ ব্যাপারে জানিয়ে দিয়েছেন, তাই আমি চলে এসেছি। অতঃপর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. ও সাহাবায়ে কেরাম বনু নাযীরের ইহুদিদেরকে সাত রাত অবরোধ করে রাখেন। তারা তাদের থেকে অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার আবেদন করে এবং তরবারি ব্যতীত মদিনা থেকে বের হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাদের আবেদনের সাথে একমত হন। তারা তাদের ঘরবাড়ি নিজ হাতে ধ্বংস করে খায়বারের দিকে বেরিয়ে যায়। এভাবে তারা নিজেদের গাদ্দারির ফলে মদিনা থেকে বহিষ্কৃত হয়।
দুমাতুল জান্দাল অভিযান
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর নিকট সংবাদ পৌঁছে যে, সিরিয়ার নিকটবর্তী এলাকা ‘দুমাতুল জান্দাল’-এর কতিপয় গোত্র পথিমধ্যে ডাকাতি করছে এবং ঐ পথে যারা যাতায়াত করছে; তাদের থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. পঞ্চম হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে ১০০০ সৈন্যের বড় একটি বাহিনী নিয়ে তাদের প্রতিহত করার জন্য বেরিয়ে পড়েন। তিনি রাতে চলতেন, দিনের বেলায় আত্মগোপন করতেন। যেন শত্রু বাহিনীর উপর হঠাৎ আক্রমণ করতে পারেন। সূর্যাস্তের সময় যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছাকাছি হলেন, দেখলেন তারা কাজ থেকে ফিরছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাদের উপর হামলা চালালেন। যাদেরকে ধরতে পেরেছেন, ধরলেন; আর যারা পালিয়ে যাওয়ার, তারা পালিয়ে গেল।
আর দুমাতুল জান্দাল অধিবাসীরা সবদিক থেকে পালিয়ে গেল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. যখন তাদের গোত্রে পৌঁছেন, সেখানে কাউকে পাননি। কিছুদিন অবস্থানের পর তিনি পুনরায় মদিনায় ফিরে আসেন।