উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. এর ছিলেন অত্যান্ত বুদ্ধিমতী, ধীসম্পন্না নারী, বাগ্মী ও হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রিয়তমা স্ত্রী। তিনি রাসুল সা.-এর নবুওয়াত লাভের চার বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কুরআন ও হাদিসের সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ থেকে বড় বড় সাহাবীগণও উপকৃত হতেন।
এক নজরে সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন | বিবরণ |
---|---|
নাম: | আয়েশা |
উপনাম: | উম্মে আব্দুল্লাহ |
উপাধি: | সিদ্দিকাহ ও হুমাইরা |
বংশধারা: | আয়েশা বিনতে আবুবকর বিন আবি কাহাফা বিন আমের বিন আমর বিন কাব বিন সাদ বিন তাইম বিন মুররাহ বিন কাব বিন লুআই ১> তাবাকাতে সাদ ১০/৫৮ |
পিতা | আবু বকর সিদ্দিক রা. |
মাতা | উম্মে রুমান রা. বিনতে উমাইর ২> তাবাকাতে সাদ ১০/৫৮ |
জন্ম: | হযরত মুহাম্মদ সা.-এর নবুয়ত প্রাপ্তির চার বছর পূর্বে |
বৈশিষ্ট্য: | রাসুল সা.-এর স্ত্রীদের মাঝে তিনিই এক মাত্র স্ত্রী; যিনি পূর্বে কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। |
মৃত্যু: | ৫৮ হিজরীর রমযান মাস |
হযরত আয়েশা রা. এর জন্ম ও পিতা মাতা:
নাম: আয়েশা। উপাধি: সিদ্দিকা ও হুমায়রা। উপনাম: উম্মে আব্দুল্লাহ। পিতার নাম: আবু বকর। মাতার নাম: জাইনাব। উপাধি: উম্মে রুমান। গোত্র: বনু তাইম। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. নবুওয়াতের চার বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা আবু বকর (রা.) ছিলেন রাসুল সা.-এর একনিষ্ঠ বন্ধু, সত্যবাদী ও ইসলামের প্রথম খলিফা।
শৈশবকাল:
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. শৈশবের দিনগুলো পিতামাতার সাথে মক্কায় অতিবাহিত করেন। সহিহ বুখারিতে শৈশবে পুতুল খেলার বিবরণ এভাবে পাওয়া যায় যে, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সামনেই আমি পুতুল বানিয়ে খেলতাম। আমার বান্ধবীরাও আমার সঙ্গে খেলতো। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘরে প্রবেশ করলে তারা দৌড়ে পালাত। তখন তিনি তাদের ডেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন এবং তারা আমার সঙ্গে খেলা করত।” ১
শুভ পরিণয়:
রাসুল সা.-এর পূর্বে হযরত আয়েশা রা.-এর বিবাহ ঠিক হয়েছিল জুবাইর ইবনে মুতয়িমের ছেলের সঙ্গে। ২
উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা রা.-এর ইন্তেকালের পর রাসুল সা. একাকিত্ব অনুভব করতে লাগলেন। খাওলা বিনতে হাকিম রা. নবিজি সা.-এর অনুমতিক্রমে বিয়ের ব্যাপারে উম্মে রুমানের কাছে বিয়ের পয়গাম পাঠান। উম্মে রুমান এ বিষয়ে আবু বকর রা. এর সাথে আলোচনা করেন। যেহেতু পূর্বে থেকেই জুবাইর ইবনে মুতয়িমের সাথে হযরত আয়েশা রা. এর বিবাহের ব্যাপারে ওয়াদা ছিল। তাই তিনি বলেন: ‘আমি জুবাইর ইবনে মুতয়িমকে ওয়াদা দিয়েছি।’
তবে গৃহে ইসলাম প্রবেশের আশঙ্কায় জুবাইর ইবনে মুতয়িম বিবাহ ভেঙে দেয়। ফলে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকায় হযরত আবু বকর রা. হযরত আয়েশা রা. কে রাসুল সা.-এর সাথে বিয়ে দেন। নবুওয়াতের দশম বছর এ বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের মোহর ধার্য করা হয় ৫০০ দিরহাম। বিয়ের সময় উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. এর বয়স ছিল ৬ বছর। ৩
বিবাহের বিবরণ এভাবে পাওয়া যায় যে, হযরত আয়েশা রা. সমবয়সি মেয়েদের সাথে খেলছিলেন। থেকে মা তাকে ঘরে নিয়ে আসেন। আবু বকর রা. এসে বিয়ে পড়িয়ে দেন। তিনি নিজেই বলেন: আমি বুঝতে পারিনি যে, রাসুল সা.-এর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। যখন আমার মা আমার বাইরে যাওয়ার উপর কঠোরতা আরোপ শুরু করেন। তখন বুঝতে পারি যে, আমি বিবাহিত। পরবর্তীতে মা আমাকে বিষয়টি বুঝিয়ে দেন। ৪
মদিনায় হিজরত:
রাসুল সা.-এর সাথে আবু বকর রা. মদিনায় হিজরতের পর আব্দুল্লাহ বিন উরাইকিতকে পাঠান মক্কা থেকে উম্মে রুমান, আসমা ও আয়েশা রা. কে মদিনায় নিয়ে আসার জন্য। মদিনায় গমনের পর তিনি রাসুল সা.-এর গৃহে আগমন করেন।
জীবন সন্ধিক্ষণে…
রাসুল সা. অন্তিম মুহূর্তে অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তিনি বার বার অন্যান্য স্ত্রীদেরকে জিজ্ঞাসা করছিলেন যে, ‘আগামীকাল আমি কার ঘরে থাকবো?’ রাসুল সা.-এর এমন ব্যাকুলতা দেখে একদিন বাকি থাকতেই উম্মাহাতুল মুমিনীনগণ তাঁকে হযরত আয়েশা রা.-এর গৃহে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন।
ওয়াফাতের পূর্বে হযরত আয়েশা রা.-এর ভাই আব্দুর রহমান রা.-এর হাতে মেসওয়াক দেখে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন মেসওয়াকের দিকে। হযরত আয়েশা রা. বুঝতে পেরে আব্দুর রহমানের হাত থেকে মেসওয়াকটি নিয়ে চিবিয়ে নরম করে দেন। অতঃপর রাসুল সা. সেই মেসওয়াক দিয়ে মেসওয়াক করেন। ৫
এজন্য হযরত আয়েশা রা. গর্ব করে বলতেন: ‘অন্য স্ত্রীদের তুলনায় এটাও আমার একক অর্জন; নবীজি সা. তার অন্তিম সময়েও আমার লালা তার মুখে লাগিয়েছেন।’
রাসুল সা.-এর ইন্তেকালের পর হযরত আয়েশা রা.-এর গৃহেই রাসুল সা. কে দাফন করা হয়। যা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা.-এর মর্যাদার অন্যতম আরেকটি কারণ।
আয়েশা রা.-এর পবিত্রতার ব্যাপারে আয়াত
ইফকের ঘটনার প্রেক্ষিতে হযরত আয়েশা রা.-এর পবিত্রতার ব্যাপারে আল্লাহ তায়লা ১০টি আয়াত নাজিল করেন। হযরত আয়েশা (রা.) বললেন: আল্লাহ (আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে) যে দশটি আয়াত নাজিল করেছেন, তা হলো এই –
“যারা এ অপবাদ রটনা করেছে তারা তো তোমাদেরই একটা দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছে কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মু’মিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি, এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ। তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাবাদী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছাড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিলনা এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপার বলে ভাবছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। এবং এ কথা শোনামাত্র তোমরা কেন বললে না যে, এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদের জন্য উচিত নয়। আল্লাহ পবিত্র, মহান! এ তো এক গুরুতর অপবাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো তাহলে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবে না, আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেত না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। – [আল কুরআন ২৪: ১১-২০]
স্বভাব ও চরিত্র:
তিনি অল্পে তুষ্ট ছিলেন। উদারতা ও দানশীলতায় তিনি ছিলেন অনন্য। একবার মুয়াবিয়া রা. তার কাছে এক লক্ষ দিরহাম প্রেরণ করেন। তিনি নিজের জন্য কিছু না রেখে অর্থগুলো লোকদের মাঝে বিলিয়ে দেন। ৬
তিনি রোজা রাখতেন এবং হজের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। প্রতি বছর হজ পালন করতেন। জীবনে বহু বার গোলাম খরিদ করে মুক্ত করে দিয়েছেন। মৃত্যু পর্যন্ত হযরত আয়েশা রা.-এর হাতে আজাদকৃত গোলামের সংখ্যা ৬৭ জন।
সন্তানাদি:
হযরত আয়েশা রা.-এর কোনো সন্তান ছিল না। তবে তিনি তার ভাগিনা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমানকে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাই আব্দুল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করে তাঁকে ‘উম্মে আব্দুল্লাহ’ বলা হতো।
ইন্তেকাল:
হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর খেলাফতের শেষের দিকে ৫৮ হিজরির রমাদান মাসে হযরত আয়েশা রা. এ দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। অসিয়ত অনুযায়ী তাকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। জানাজার নামাজের ইমামতি করেন হযরত আবু হুরাইরা রা.। দাফন কাজে অংশগ্রহণ করেন: কাসেম ইবনে মুহাম্মদ, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহ ইবনে আতীক, উরওয়া ইবনে জুবাইর এবং আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইন।
তাহকীক ও তাখরীজ:
১. আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ (সহীহ বুখারী) হাদীস নং: ৫৭০০ আন্তর্জাতিক নং: ৬১৩০
২. الطبقات الكبير» (10/ 59 ط الخانجي)
৩. الطبقات الكبير» (10/ 58 ط الخانجي)
৪. তাবাকাতে ইবনে সাদ: ৮/৪৬-৪৭ [দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ]
৫. মুসনাদে আহমদ: ২৫৬৪০
৬. মুসতাদরাকে হাকেম ৪/১৫ [দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ]