হযরত খাদিজা রা. ছিলেন একজন গুণবতী, সম্মানিতা, বিদুষী নারী ও হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রিয়তম স্ত্রী; যার জীবদ্দশায় রাাসুল সা. দ্বিতীয় কোনো বিবাহ করেন নি। তিনিই সর্বপ্রথম রাসুল সা.-এর উপর ইমান আনেন।
নিচে সংক্ষেপে হযরত খাদিজা রা.-এর জীবনী তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন | উত্তর |
---|---|
নাম: | খাদিজা |
উপনাম: | উম্মে হিন্দা, |
উপাধী: | তাহিরা |
বংশধারা: | খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আব্দুল উজ্জা ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব আল-কুরাইশী আল-আসাদিয়্যাহ |
পিতা | খুওয়াইলিদ |
মাতা | ফাতিমা বিনতে জায়েদা |
জন্ম: | হস্তীবাহিনীর ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পনেরো বছর পূর্বে |
বৈশিষ্ট্য: | হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রিয়তম স্ত্রী; যার জীবদ্দশায় রাাসুল সা. দ্বিতীয় কোনো বিবাহ করেন নি। |
মৃত্যু: | নবুওয়াতের ১০ম বছর হিজরতের তিন বছর পূর্বে ৬৪ বছর ০৬ মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন |
খাদিজা রা.-এর জন্ম ও পিতা মাতা:
নাম: খাদিজা, উপনাম: উম্মে হিন্দা, উপাধি: তাহিরা। বংশ পরিক্রমা: খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আব্দুল উজ্জা ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব আল-কুরাইশী আল-আসাদিয়্যাহ। ১,২ মায়ের নাম: ফাতিমা বিনতে জায়েদা। হযরত খাজিদা রা. হস্তীবাহিনীর ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পনেরো বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন।
খাদিজা রা.-এর বিবাহ:
প্রথমে তিনি আবু হালার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন। তার মৃত্যুর পর তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন আতীক এর সাথে। আতীক মৃত্যু বরণ করলে তিনি নবুওয়াতের ১৫ বছর পূর্বে রাসুল সা.-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন।
রাসুল সা.-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আগ্রহী হওয়ার কারণ হলো: ব্যবসায়ী পণ্য নিয়ে সফরকালে হযরত খাদিজা রা.-এর গোলাম মাইসারা রাসুল সা.-এর সঙ্গে ছিল। তিনি রাসুল সা.-এর মাঝে নবুওয়াতের বহু নিদর্শন দেখতে পান আর তা বুহাইরা পাদ্রী সত্যায়ন করেন। ৪ সফরের পুরো ঘটনা খাদিজা রা. তে জানালে তিনি রাসুল সা.-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন।
বিবাহের বিবরণ এভাবে পাওয়া যায় যে, হযরত খাদিজা রা. মক্কার সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য নারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। স্বামী বিয়োগের পর মক্কার সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তিদের পক্ষ থেকে তার নিকট বহু বিয়ের প্রস্তাব আসত। কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন এমন কাউকে, যিনি হতেন বিশ্বস্ত ও সৎ। এদিকে মাইসার কাছে রাসুল সা.-এর ভুয়সী প্রশংসা শুনে তিনি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে আগ্রহী হোন। তিনি তার দুধ বোন ও বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনাব্বিহ এর মাধ্যমে রাসুল সা.-এর নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। নবিজি সা. তার প্রস্তাব গ্রহণ করলে বিয়ের দিন-তারিখ ধার্য করা হয়।
নির্ধারিত দিনে রাসুল সা.-এর চাচা আবু তালেব, হামজাসহ মক্কার গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ খাদিজা রা.-এর গৃহে যান। হযরত খাদিজা রা.-এর খান্দান থেকেও কয়েকজন গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ বিয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সকলের উপস্থিতিতে আবু তালেব বিয়ের খুতবা পাঠ করেন। বিয়ের মোহর নির্ধারণ করা হয় ৫০০ দিরহাম। বিয়ের সময় হযরত খাদিজা রা.-এর বয়স ছিল ৪০ বছর আর নবীজি সা.-এর বয়স ছিল ২৫ বছর।
খাদিজা রা.-এর ইসলাম গ্রহণ:
রাসুল সা. কে নবুওয়াত প্রদান করা হলে সর্বপ্রথম রাসুল সা.-এর উপর ইমান আনেন হযরত খাদিজা রা.। এর বিবরণ সহিহ বুখারিতে হযরত আয়েশা রা.-এর সূত্রে এভাবে পাওয়া যায় যে,
আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি সর্বপ্রথম যে ওহি আসে, তা ছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে ভোরের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর তাঁর কাছে নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়ে এবং তিনি ‘হেরা’ র গুহায় নির্জনে থাকতেন। আপন পরিবারের কাছে ফিরে আসা এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া- এইভাবে সেখানে তিনি একাধারে বেশ কয়েক রাত ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন। তারপর খাদিজা (রা.)-এর কাছে ফিরে এসে আবার অনুরূপ সময়ের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতেন।
এমনিভাবে ‘হেরা’ গুহায় অবস্থানকালে একদিন তাঁর কাছে ওহী এলো। তাঁর কাছে ফিরিশতা এসে বললেন, পড়ুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: আমি বললাম, আমি পড়ি না। তিনি বলেন: তারপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হল। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুন। আমি বললাম: আমি তো পড়ি না। তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হল। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন: পড়ুন। আমি জবাব দিলাম, আমি তো পড়ি না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, তারপর তৃতীয়বার তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুন আপনার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে। পড়ুন আর আপনার রব মহামহিমান্বিত। (৯৬: ১-৩)
তারপর এ আয়াত নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফিরে এলেন। তাঁর অন্তর তখন কাঁপছিল। তিনি খাদিজা রা.-এর কাছে এসে বললেন: আমাকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দাও। তাঁরা তাঁকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাঁর ভয় দূর হল। তখন তিনি খাদীজা (রা.) এর কাছে সকল ঘটনা জানিয়ে তাঁকে বললেন, আমি নিজের উপর আশঙ্কা বোধ করছি।
খাদিজা (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম, কখনো না। আল্লাহ্ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারি করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।
এরপর তাঁকে নিয়ে খাদীজা (রা.) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফিল ইবনে আব্দুল আসাদ ইবনে আব্দুল উজ্জার কাছে গেলেন, যিনি জাহিলী যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানি ভাষা লিখতে জানতেন এবং আল্লাহর তাওফীক অনুযায়ী ইবরানি ভাষায় ইনজীল থেকে অনুবাদ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা (রা.) তাঁকে বললেন, হে চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাতিজা! তুমি কী দেখ? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা দেখেছিলেন, সবই খুলে বললেন। তখন ওয়ারাকা তাঁকে বললেন, ইনি সে দূত যাঁকে আল্লাহ্ মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম।
আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বের করে দেবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: তাঁরা কি আমাকে বের করে দিবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব। এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা (রা.) ইন্তিকাল করেন। আর কিছুদিন ওহী স্থগিত থাকে। – [ আল জামিউস সহিহ- ইমাম বুখারী রহ. (সহীহ বুখারী) হাদিস নং: ৩ আন্তর্জাতিক নং: ৩ – ৪]
রাসুল সা.-এর দুঃখের দিনে ছায়া হিসেবে পাশে ছিলেন খাদিজা রা.। কাফেররা যখন রাসুল সা. কে নানাভাবে কষ্ট দিতো তখন হযরত খাদিজা রা. সাহস যোগাতেন। দুঃখ-কষ্টে সর্বদা পাশে থাকতেন। যখন কুরাইশরা রাসুল সা. ও তার গোত্রকে আবু তালেব উপত্যকায় দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত অবরোধ করে রেখেছিল। তখন হযরত খাদিজা রা. পুরো সময়টাতে রাসুল সা.-এর সাথে আবদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। সেখানে তীব্র ক্ষুধা নিবারণের জন্য গাছের পাতা পর্যন্তও খেতে হয়েছিল।
সন্তানাদি:
হযরত খাদিজা রা.-এর গর্ভে বেশ কয়েকজন সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম স্বামী আবু হালাহর ঔরসে জন্ম হয় হালাহ ও হিন্দ এর। দ্বিতীয় স্বামী আতিকের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন হিন্দা নান্মী নামে এক কন্যা সন্তান। রাসুল সা. এর ঔরসে জন্ম গ্রহণ করেন দুই জন ছেলে এবং চার জন কন্যা সন্তান।
রাসুল সা. এর ঔরসে জন্মানো সন্তানদের নামের তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলো:
- কাসিম। তার নামেই রাসুল সা.-এর উপনাম আবুল কাসিম।
- জাইনাব।
- আব্দুল্লাহ।
- .রুকাইয়া।
- উম্মে কুলসুম।
- ফাতিমা জাহরা।
বৈশিষ্ট্য:
হযরত খাদিজা রা. ছিলেন মক্কার সম্ভ্রান্ত নারীদের একজন, বুদ্ধিমতী, সম্মানিতা, বিদুষী; ইবরাহীম ব্যতীত রাসুল সা.-এর সকল সন্তানের জননী, তাঁর নবুওয়াতের উপর প্রথম বিশ্বাসী এবং তাঁর আনীত বিধি-বিধান সত্যায়নকারিনী। তাঁর বিয়োগের পর রাসুল সা. তার প্রশংসা করতেন এবং সকল উম্মাহাতুল মুমিনিনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করতেন। এমনকি হযরত আয়েশা রা. বলেন: রাসুল সা.-এর অধিক আলোচনার কারণে আমি খাদিজার ব্যপারে যতটুকু ঈর্ষা করি অন্য কোনো নারীর ব্যাপারে ততটুকু করি না। ৩ তাঁর জীবদ্দশায় রাসুল সা. দ্বিতীয় বিবাহ করেন নি।
ইন্তেকাল:
রাসুল সা.-এর সঙ্গে বিবাহের পর খাদিজা সা. দীর্ঘ পঁচিশ বছর জীবিত ছিলেন। ইসলামের শুরুর দিকে রাসুল সা.-এর উত্তম সঙ্গিনী হিসেবে পাশে ছিলেন। নবুওয়াতের ১০ম বছর হিজরতের তিন বছর পূর্বে ৬৪ বছর ০৬ মাস বয়সে পরকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তখন পর্যন্ত জানাজা নামাজের বিধান অবতীর্ণ না হওয়ার বিনা জানাজাতে তাকে দাফন করা হয়। ৫ দাফন কাজে রাসুল সা. স্বয়ং শরিক ছিলেন।
তাহকীক ও তাখরীজ:
« بنت خويلد بن أسد بن عبد العزى بن قصي خديجة »1.
[«الطبقات الكبير» (10/ 52 ط الخانجي):]
2. من مصادر ترجمتها: سير أعلام النبلاء ج: 2 ص: 109، والسمط الثمين: ص 16
3. إن عائشة كانت تقول: ما غرت من امرأة ما غرت من خديجة، من كثرة ذكر النبي صلى الله عليه وسلم لها – كذا في سير أعلام النبلاء ج: 2 ص: 110
الإصابة ج: 8 ص: 99 .4
[«الطبقات الكبرى – ط العلمية» (8/ 14):]5.
«أخبرنا محمد بن عمر. حدثني معمر بن راشد عن الزهري عن عروة عن عائشة قالت: توفيت خديجة قبل أن تفرض الصلاة. وذلك قبل الهجرة بثلاث سنين»