ফিতরাত (الْفِطْرَةُ) হলো মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য, যা আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির সূচনাতেই নির্ধারণ করেছেন। আল্লামা কাজি ইয়াজ (রহ.) এবং মুহাদ্দিসীনে কেরাম এ বৈশিষ্ট্যগুলোকে ‘সুন্নতে কাদিম’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এগুলো এমন সৃষ্টিগত গুণাবলি যা সকল নবী-রাসূলের মধ্যে বিদ্যমান ছিল এবং পূর্ববর্তী সকল শরিয়তে এটি স্বীকৃত ছিলো।
ফিতরাত অর্থ কি?
ফিতরাত অর্থ হলো, মানুষের ঐ স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যকে, যে বৈশিষ্ট্যের উপর তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
ইসলামের মৌলিক দশটি ফিতরাত
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
“দশটি কাজ ফিতরাতের অন্তভুক্ত– গোঁফ খাটো করা, দাঁড়ি লম্বা করা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি দেয়া, নখ কাটা, নাক কানের ছিদ্র এবং আঙ্গুলের গিরাসমুহ ধোয়া, বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নাড়ির নীচের পশম কাটা এবং পানি দ্বারা ইসতিনজা করা।”
হাদীসের রাবী হযরত মুসআব (রা.) বলেন, দশম কাজটির কথা আমি ভুলে গিয়েছি। সম্ভবত সেটি হবে কুলি করা। এ হাদীসের বর্ণনায় কুতায়বা আরো একটি বাক্য বাড়ান যে, ওয়াকী বলেন, انْتِقَاصُ الْمَاءِ অর্থ ইস্তিনজা করা।
তথ্যসূত্র: সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ৪৯৭।
গোঁফ কর্তন করা (قَصُّ الشَّارِبِ)
গোঁফ খাটো করা ফিতরাতের গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি মুখমণ্ডল পরিচ্ছন্ন রাখার অংশ। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, গোঁফ খাটো করা সুন্নত। অর্থাৎ উপরের ঠোঁটের উপর গজানো পশমকে একেবারে মূল থেকে না ছেঁটে কেটে নেয়া সুন্নত। তবে গোঁফ কর্তনের ব্যাপারে হাদিসে বিভিন্ন ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
দাঁড়ি লম্বা রাখা (إِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ)
ড়ি রাখা ইসলামের অন্যতম পরিচায়ক। এটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা এবং প্রত্যেক নবী-রাসূল দাঁড়ি রাখতেন। তাছাড়া এটি ইসলামের শিআরের অন্তর্ভুক্ত। এক মুষ্ঠির নিচে দাড়ি খাটো করা কবীরা গোনাহের কাজ।
অজ্ঞতাবশত অনেকে দাড়ি রাখাকে সুন্নত গাইরে মুয়াক্কাদা মনে করেন। অথচ দাড়ি রাখা সুন্নতে ওয়াজিবা-এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এর গুরুত্ব সুন্নতে মুয়াক্কাদার চেয়েও বেশী এবং তা পরিত্যাগ করলে গোনাহগার হবে।
মেসওয়াক করা (وَالسِّوَاكُ)
মেসওয়াক মুখের দুর্গন্ধ দূর করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মেসওয়াকের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন:
“যদি আমি আমার উম্মাতের জন্য কষ্টসাধ্য হবে বলে মনে না করতাম, তাহলে তাদেরকে প্রত্যেক ওযুর সাথে মিসওয়াক করার জন্য নির্দেশ প্রদান করতাম।”
-(ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার – ৭৩)
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:,
“মিসওয়াক মুখের পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ ও আল্লাহর সন্তোষ লাভের উপায়।”
– (নাসায়ী; হাদিস নং: ১৩৭৫)
নাকে পানি প্রবেশ করানো (اسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ)
নাকে প্রবেশ করানো অজুর একটি অংশ ও সুন্নত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: “কুলি করা এবং নাকে পানি দেওয়া ফিতরতের অন্তর্ভুক্ত।“
নখ কর্তন করা (قَصُّ الأَظْفَارِ)
নখ পরিষ্কার রাখা পরিচ্ছন্নতার অংশ। ইমাম নববী (রহ.) বলেন: নখ কাটার ক্ষেত্রে মুস্তাহাব পদ্ধতি হলো, প্রথমে হাতের নখ কাটা এবং পরে পায়ের নখ কাটা। হাতের মধ্যে আবার প্রথমে ডান হাতের শাহাদাত অঙ্গুলির নখ, এরপর মধ্যমা, এরপর অনামিকা, এরপর কনিষ্ঠা, এরপর বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ কাটবে। তারপর বাম হাতের প্রথমে কনিষ্ঠা, এরপর অনামিকা- এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষে বৃদ্ধাঙ্গুলিতে আসবে। এরপর ডান পায়ের কনিষ্ঠা থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে বাম পায়ের কনিষ্ঠায় গিয়ে শেষ করবে।
আঙুলের গিরাসমূহ ধোয়া (غَسْلُ الْبَرَاجِمِ)
অজু ও গোসলের সময় আঙ্গুলের গিরাসমুহ ভালো করে ধৌত করা ফিতরতের অন্তর্ভুক্ত।
বগলের পশম উপড়ানো (نَتْفُ الإِبْطِ)
বগলের পশম পরিষ্কার রাখা ইসলামের পরিচ্ছন্নতার সুন্নতগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি শারীরিক পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি অপ্রীতিকর গন্ধ দূর করতে সহায়ক।
নাভির নিচের পশম পরিষ্কার করা (حَلْقُ الْعَانَةِ)
নাভির নিচের পশম পরিষ্কার করা সুন্নত। এটি শুধু শরীরের পরিচ্ছন্নতার জন্য নয়, বরং ইসলামের সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলাবোধের প্রতিফলন। ইসলামী শরিয়ত শুধু ইবাদতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিসৃত। বান্দার প্রতিটি কর্ম কিভাবে এবং কোন পদ্ধতিতে সম্পন্ন হবে; এর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ইসলামী শরিয়তে।
মানুষের মৌলিক চাহিদা, আচার-ব্যবহার, নম্রতা-ভদ্রতা, তাদীব-তামাদ্দুনসহ দৈনন্দিন যাবতীয় বিষয়াবলির সমাধান ইসলামে রয়েছে। এর দ্বারা ইসলামের মহত্ত্ব, স্যৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বুঝে আসে।
পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা (وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ)
ইস্তিঞ্জা করা ইসলামের পরিচ্ছন্নতার অপরিহার্য অংশ। মহান আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ পবিত্রতা অবলম্বনকারীকে ভালোবাসেন”। [সূরা তওবা: ১০৮]।
কুলি করা (الْمَضْمَضَةَ)
কুলি করা অজুর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত এবং এটি মুখগহ্বরের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করে। এটি নিয়মিত পালন করলে মুখের জীবাণু দূর হয়।
ইসলামের মৌলিক ফিতরাত দশটি এমন বৈশিষ্ট্য এবং অভ্যাসের সমষ্টি, যা মানুষকে শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে পরিচ্ছন্ন রাখতে সাহায্য করে। এগুলো কেবলমাত্র ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার জন্য নয়, বরং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও সুন্নতের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশিত এই অভ্যাসগুলো মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত এই সুন্নতগুলো জীবনে অন্তর্ভুক্ত করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।