প্রাত্যহিক জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান ও রাসুল সা.-এর দেখানো পদ্ধতিকে ইসলামী অর্থনীতি বলে। – এটি ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অনুসরণীয়।
ইসলামী অর্থব্যবস্থা সমাজ থেকে অর্থ কেন্দ্রিক প্রতারণা, সম্পদের অসম বণ্টন ও অর্থনৈতিক শোষণ প্রতিহত করে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা পালন করে।
মূলত ইসলাম একটি আদর্শ দ্বীন ও জীবনব্যবস্থা। এর বৃহৎ অংশ অর্থ কেন্দ্রিক বিষয়াবলির সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামী অর্থব্যবস্থার আওতাধীন বহু ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন: ব্যবসা-বাণিজ্য, যাকাত, গনিমত, জিযিয়া, ফিদিয়া, কাফফারা, সদকা, হিবা, হাদিয়া, ওয়াকফ, রাজস্ব, ব্যাংকিং, রিবা (সুদ), মিরাস (উত্তরাধিকার), মোহর, জরিমানা, সামরিক, স্বর্ণ, রূপা, কৃষিজ সম্পদ, পশুপাল, শ্রমবাজার, দেশীয় ও বৈদেশিক কারেন্সি, হুন্ডি, বীমা, ঋণ, খনিজ সম্পদ, পরিত্যক্ত বস্তু বা সম্পদ ইত্যাদি।
ইসলাম ও পুঁজিবাদ – অর্থব্যবস্থা ও অর্থনীতির বিশ্লেষণ:
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে ইসলাম ও পুঁজিবাদ – অর্থব্যবস্থা ও অর্থনীতির মাঝে পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হলো। এ দুইয়ের উৎস বা সূচনাকাল, স্বার্থ, রিবা, নৈতিক সীমারেখা, সম্পদে ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণসহ ভূমি, উৎপাদন, শ্রম ও উদ্যোক্তা কেন্দ্রিক ধারণা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
উৎস বা সূচনা:
ইসলামী অর্থনীতির সূচনা হয় নববী যুগে। এর মৌলিক উৎস হলো কুরআন ও হাদিস। সহযোগী উৎস ইজমা ও ক্বিয়াস।
অপরদিকে পুঁজিবাদের উত্থান ঘটে শিল্পবিপ্লবের পর। সামন্ত প্রভুদের স্বার্থ জিইয়ে রাখতে পুঁজিবাদ আমদানি হয়।
ভূমি, উৎপাদন, শ্রম ও উদ্যোক্তা কেন্দ্রিক ধারণা:
পুঁজিবাদী অর্থনীতি: পুঁজিবাদে সম্পদ বণ্টন ও আয় বিতরণের একটি নির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে, যেখানে প্রতিটি উৎপাদন উপাদান নির্দিষ্ট প্রতিদান পেয়ে থাকে। যেমন:
- ভূমির মালিক: ভূমি ব্যবহারের বিনিময়ে ভাড়া বা মূল্য পান।
- মূলধনদাতা: মূলধনের বিনিময়ে সুদ লাভ করেন। ঝুঁকি গ্রহণ করুক বা না করুক।
- শ্রমিক: কাজের বিনিময়ে নির্ধারিত মজুরি পান।
- উদ্যোক্তা: এককভাবে মুনাফার মালিকানা লাভ করেন।
ইসলামী অর্থনীতি: ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মূলনীতি হলো: “মুনাফা সেই পাবে, যে ঝুঁকি গ্রহণ করবে।” – এই নীতির ভিত্তিতে ইসলামী অর্থনীতিতে আয় বণ্টনের ধারা নিম্নরূপ:
- ভূমির মালিক: ভূমি ব্যবহৃত হলে ন্যায্য ভাড়া বা মূল্য পেয়ে থাকেন।
- মূলধনদাতা: যদি মূলধন ঋণ হিসেবে প্রদান করেন, তাহলে শুধু মূলধন ফেরত পাবেন। এর বিপরীতে কোনো অতিরিক্ত অর্থ (সুদ) পাবেন না।
আর যদি মূলধন বিনিয়োগ করেন অর্থাৎ মুনাফা ও ক্ষতির ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকেন; তাহলে মুনাফার অংশ লাভ করবেন। - শ্রমিক: কাজের সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে ন্যায্য মজুরি পান।
- উদ্যোক্তা: ঝুঁকি গ্রহণের ভিত্তিতে মুনাফা লাভ করেন।
ইসলামী অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রতিটি অংশে ন্যায়বিচার, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ঝুঁকি ভাগাভাগির মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবিক অর্থনীতি গড়ে তোলা হয়।
স্বার্থ:
পুঁজিবাদ ব্যক্তি স্বার্থকে সমাজের সবার স্বার্থের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, পরস্পর-পরস্পরকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো মানসিকতা দূর হয়ে যায়। ব্যক্তি কেন্দ্রিক কল্যাণ, মুনাফা ও স্বার্থকে প্রাধান্য পায়।

অপরদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তির তুলনায় সামগ্রিক কল্যাণ ও স্বার্থ অগ্রাধিকার লাভ করে। সামগ্রিক কল্যাণ বিবেচনায় ব্যক্তি স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
রিবা (সুদ):
পুঁজিবাদ সুদকে উৎসাহিত করে এবং অর্থ উপার্জনের মাধ্যম মনে করে। সুদের বিরুদ্ধে মোটেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। অপরদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে রিবা (সুদ) কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
ভারসম্যহীনতা দূরীকরণ:
সমাজে ধনী-গরীব একে অপরের পরিপূরক। তাদের মাঝে ব্যবধান থাকাটা যুক্তিযুক্ত। এ ব্যবধান না থাকলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। তবে এ ব্যবধান হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ইনসাফপূর্ণ। ধনী আরো ধনী হবে, গরীব আরো গরীব হবে – ইসলামী অর্থনীতি এমন নীতিতে বিশ্বাসী নয়।
ইসলামী অর্থনীতি সম্পদে ভারসাম্যহীনতা ও একচ্ছত্র মালিকানা দূরীকরণে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা রাখে যাকাত, হিবা, হাদিয়া, সদকা, ওয়াকফ, মিরাছ ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলো।

এসব উদ্যোগের ফলে যারা ভূমি, শ্রম, মূলধনদাতা ও উদ্যোক্তা – কোনটিই হতে পারছে না। অর্থাৎ সমাজের সেই সকল পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী; যারা অর্থনৈতিক সব ধরনের কার্যক্রম থেকে একেবারেই অক্ষম হয়ে পড়েছে। ইসলামী অর্থনীতি এই অসহায় ও অক্ষম জনগোষ্ঠীকে সম্পদ থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করে না। বরং তাদেরকেও ন্যায্য হিসসা প্রদান করে থাকে।
অপরদিকে পুঁজিবাদ সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণে এধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না।
নৈতিক সীমা:
ইসলামী অর্থব্যবস্থায় আয়-উপার্জনের নৈতিক সীমা রয়েছে। রিবা (সুদ), গারার (প্রতারণা), ক্বিমার (জুয়া), অবৈধ পন্থায় উপার্জন – সবই নিষিদ্ধ। অপরদিকে পুঁজিবাদে সম্পদ উপার্জনের নৈতিক কোনো সীমারেখা বা বিধি-নিষেধ নেই।
সংক্ষেপে ইসলামী ও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মাঝে পার্থক্য তুলে ধরা হলো:
বিষয়: | ইসলামী অর্থব্যবস্থা: | পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা: |
---|---|---|
ধর্মীয় ভিত্তি: | ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ইসলামী শরিয়াহর উপর প্রতিষ্ঠিত। | পুঁজিবাদ ধর্মনিরপেক্ষ ও মানব রচিত নীতির উপর নির্ভরশীল। |
আইন ও নীতিমালা: | এটি আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা পরিচালিত হয়। | মানবসৃষ্ট আইন ও নীতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। |
সুদের অবস্থান: | রিবা (সুদ) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। | সুদ গ্রহণযোগ্য এবং আর্থিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রবিন্দু। |
ব্যক্তিস্বার্থ: | ব্যক্তিস্বার্থ উপেক্ষিত হয়। | ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পায়। |
দান ও আর্থিক সহায়তা: | আর্থিক অস্বচ্ছলতা দূরীকরণে বাধ্যতামূলক ও অবাধ্যতামূলক নৈতিক দানব্যবস্থা রয়েছে। যেমন: যাকাত, ওয়াক্ফ, সাদাকা, হিবা, করদ ইত্যাদি। | বাধ্যতামূলক ও অবাধ্যতামূলক নৈতিক দানব্যবস্থা নেই। |
সম্পদের বণ্টন: | সমাজে সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে। | ধনীরা আরও ধনী হয়, দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়—বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। |
উপার্জনের নৈতিক সীমা: | অর্থ উপার্জনের নৈতিক সীমা রয়েছে; হারাম পন্থায় উপার্জন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যেমন: সুদ, ক্বিমার, গারার ইত্যাদি। | অর্থ উপার্জনের নৈতিক কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। মুনাফা যে পদ্ধতিতেই আসুক তা গ্রহণযোগ্য। |
শেষ কথা:
ইসলামী অর্থব্যবস্থা একটি ন্যায়ভিত্তিক, ভারসাম্যপূর্ণ এবং মানবিক অর্থব্যবস্থা, যা আল্লাহ প্রদত্ত বিধানাবলি ও রাসূল (সা.)-এর নির্দেশনার আলোকে পরিচালিত হয়। এটি শুধু ব্যক্তি কেন্দ্রিক নয়, বরং সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করে। অন্যদিকে পুঁজিবাদ ব্যক্তি স্বার্থ ও মুনাফাকে অগ্রাধিকার দেয়, যার ফলে সমাজে বৈষম্য, শোষণ ও নৈতিক অধঃপতন দেখা দেয়। ইসলামী অর্থব্যবস্থা সুদ, জুয়া ও প্রতারণা নিরুৎসাহিত করে এবং যাকাত, সদকা, হাদিয়া, ওয়াকফ ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করে। ফলে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীও অর্থনৈতিক প্রবাহে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। সুতরাং, ইসলামী অর্থনীতি একটি পূর্ণাঙ্গ ও নৈতিক বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হয়, যা শুধু মুসলিম সমাজ নয়, বিশ্বব্যাপীও একটি সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।