ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহিমহুল্লাহ) ২৩৬ হিজরীতে ইরাকের বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন একজন হাদিস বিশারদ, সমকালীন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস এবং যুগ শ্রেষ্ঠ ফকিহ। مسند أحمد بن حنبل (মুসনাদ আহমদ ইবনে হাম্বল) নামে তার সংকলিত হাদিসের গ্রন্থ রয়েছে; যাতে তিনি প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার হাদিস সংকলষ করেন। এছাড়াও তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর অনুসারীদেরকে ‘হাম্বলী’ বলা হয়।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.-এর যুগে ‘খলকে কুরআন’ এবং ‘আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকার’-এর ফেতনা বিস্তৃতি লাভ করে। তিনি এর কঠোর বিরোধিতা করেন। যার ফলে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. কে জেলে আবদ্ধ করা হয়, যার বিবরণ হলো এই-
ইসলামের প্রথম দুই খলীফা আবু বকর ও উমর রা.-এর শাসনামলে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ ছিল না। সকলেই এক উম্মত ছিল। হযরত উমর রা. কে শহীদ করে দেওয়ার মাধ্যমে প্রবহমান ফেতনার দরজা ভেঙে দেওয়া হল, যার ভবিষ্যত বানী স্বয়ং রাসুল সা. করেছেন।
একইভাবে হযরত উসমান, আলী রা. কে শহীদ করে দেওয়া হয়। হযরত মুয়াবিয়া রা. ক্ষমতা থেকে গত হওয়ার পর ইয়াজিদ ক্ষমতা গ্রহণ করে।
তার থেকে মন্দ লোকদের শাসনামলের সূচনা হয়। মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা প্রকাশ পেতে শুরু করে। এমন বহু দলের আবির্ভাব ঘটে, যারা সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদাকে অস্বীকার করে বসে। এভাবেই ক্রমাগত ফেতনার আবির্ভাব ঘটে। এক পর্যায়ে মামুন খেলাফতের দ্বায়িত্বে বসেন।
খলীফা মামুন ছিলেন একজন বুদ্ধিমান এবং মুতাকাল্লিম (তর্ক শাস্ত্রবীদ।) তিনি পূর্ববর্তীদের কিতাব এবং ইউনান শাস্ত্রদের উপর লিখিত কিতাব জমা করে লাগলেন এবং সেগুলো নিয়ে গবেষণা করতে লাগলেন।
মুতাজিলাদের একদল তাকে সৎ পথ থেকে সরিয়ে পথভ্রাষ্ট করল। তারা তার সামনে ‘খলকে কুরআন এবং আল্লাহ তায়ালার গুণাবলি’-এর অস্বীকারকে সুসজ্জিতভাবে উপস্থাপন করল। তিনি তাদের ফাঁদে পা দিলেন।
এভাবেই দীর্ঘকাল অতিবাহিত হলো। মানুষের মাঝে ‘খলকে কুরআন এবং আল্লাহ তায়ালার গুণাবলি’ অস্বীকারের ফেতনা ছড়িয়ে পড়ল। ফলে উলামায়ে কেরাম দীর্ঘ পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন।
খলিফা মামুনের পূর্বে আব্বাসীয় এবং উমাইয়া খেলাফতের সকলেই সাফালে সালেহীনদের রিতী নিতি এবং মাজহাবের অনুসারী ছিলেন।
খলিফা মামুন রোম যুদ্ধে অংশগ্রহণের পূর্বে তার নায়েবে বাগদাদের কাছে চিঠি লেখেন। যাতে তিনি মানুষকে ‘খলকে কুরআন’-এর দিকে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার আদেশ দেন। আর তিনি এই আদেশটি তার মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে লেখেন।
নায়েবে বাগদাদ চিঠি পাওয়া মাত্রই বড় বড় উলামায়ে কেরাম এবং হাদিসের ইমামগণকে জড়ো করে তাদের সামনে ‘খলকে কুরআন’ পেশ করেন। সকলেই তা প্রত্যাখ্যান করলে তিনি তাদেরকে শাস্তি দেওয়া এবং লাঞ্ছিত করার হুমকি প্রদান করেন। ফলে বাধ্য হলেই সকলে তার সাথে একমত পোষণ করেন।
তবে শেষ পর্যন্ত ইমাম আহমদ এবং মুহাম্মদ ইবনে নূহ ‘খলকে কুরআন’ কে অস্বীকারের উপর একমত ছিলেন। ফলে তাদেরকে বন্দি করে বাগদাদে পাঠানো হলো।
তারা খলিফার কাছে পৌঁছার পূর্বেই তাদের কাছে খলিফা মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছল।
খলিফা মামুনের পর খেলাফতের দ্বায়িত্ব লাভ করেন খলীফা মুতাসিম। তিনি তাদেরকে বাগদাদে ফিরিয়ে দেন। পথিমধ্যে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে নূহ ইন্তেকাল করেন। বাগদাদে পৌঁছার পর ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. কে ত্রিশ মাস জেলে আবদ্ধ রাখা হলো।
খলীফা মুতাসিম ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. কে বের করে এনে বেদাতীদের নেতাদের সাথে মুনাজারার জন্য পেশ করেন। তাঁকে আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক প্রশ্ন করল: আপনি কুরআনের ব্যাপারে কি বলেন?
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন: কুরআন হলো আল্লাহর ইলম। আর সে দাবি করে যে, আল্লাহর ইলম মাখলুক; সে কাফের।
তারা বলল: হে আমীরুল মুমিনীন! সে আপনাকে এবং আমাদেরকে কাফের সাব্যস্ত করেছে।
তারা তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগল। তিনি তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন।
এক পর্যায়ে খলীফা মুতাসিম তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন: হে আহমদ! এ বিষয়ে (খলকে কুরআন) আপনার মতামত কি?
তিনি তাকে বলেন: হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি আমার কাছে কুরআন বা হাদিস থেকে এমন কিছু বলুন; ফলে আমি ‘খলকে কুরআন’-এর পক্ষে কথা বলব।
ইবনে দাউদ তাঁকে বলল: আপনি তো এই এই ছাড়া (কুরআন ও হাদিস ব্যতীত) আর কিছুই বলেন না।
তিনি তাদেরকে বললেন: এ দুটি ছাড়া ইসলাম প্রতিষ্ঠিত থাকা সম্ভব?
এভাবেই দ্বিতীয়, তৃতীয় দিন তাঁকে মুনাজারার জন্য আনা হলো। প্রতিদিনই তিনি বিজয়ী হতেন এবং তার দলিল তাদের দলিলের উপর শক্তিশালী হতো।
বেদাতীদের কাছে কুরআন-হাদিসের কোনো দলিল ছিল না। এক পর্যায়ে না পেরে তারা কুরআন এবং হাদিস অস্বীকার করতে লাগল এবং যুক্তির মাধ্যমে সেগুলো প্রত্যাখ্যান করতে লাগল।
এসবের মাঝে খলিফা ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.-এর প্রতি সদয় হন। তিনি তাঁকে বলেন! হে আহমদ! আপনি শুধু ‘খলকে কুরআন’ কে স্বীকার করে নেন। আমি আপনাকে আমার বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত করবো আর আপনার মুক্তির বিষয়টি আমার হাতে ছেড়ে দিন।
তিনি বলেন: হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি আমার কাছে কুরআনের একটি আয়াত অথবা হাদিস নিয়ে আসুন। ফলে আমি এ বিষয়ে তাদের সাথে একমত হতে পারবো।
খলীফা মুতাসিম তাঁকে মুক্তি দিতে চাইলেন। নায়েবে বাগদাদ ইসহাক ইবনে ইব্রাহীম খলীফাকে বলল: হে খলীফা! এটা খেলাফতের কোনো ভালো বিষয় হতে পারে না যে, আপনি তাকে মুক্তি দিয়ে দিবেন আর সে আমাদের উপর বিজয়ী হবে।
নায়েবে বাগদাদের উসকানিতে খলিফা রাগান্তির হয়ে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. কে বন্দি করে প্রহার করার আদেশ দেন।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. কে প্রচণ্ড প্রহার করা হলো। তার শরীর থেকে রক্ত বের হতে লাগল। এক পর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে যান এবং জ্ঞান হারান।
এতে খলিফা ঘাড়রে যান এবং তিনি তাকে তার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করেন। তিনি বেদাতী ব্যতীত তাকে শাস্তি দেওয়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।
এরপর থেকে তিনি তার গৃহে অবস্থান করতেন এবং কারো সাথে কোন বিষয়ে আলোচনা করতেন না।
মুতাসিমের পর খলীফা হন তার ছেলে ওয়াছেক। তার শাসনামলে বাগদাদে ‘খলকে কুরআন’-এর ফেতনা ব্যাপক বিসৃত হলো। তিনি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.-এর কাছে চিঠি প্রেরণ করেন। তাতে তিনি তাকে শহরে-বন্দরে কোথাও অবস্থান না করতে বলেন।
ওয়াছেকের মৃত্যু পর্যন্ত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. আত্মগোপনে চলে গেলেন।
ওয়াছেকের মৃত্যুর পর খলীফা হন মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ। তিনি কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী ছিলেন। মানুষ তার খেলাফতের সুসংবাদ গ্রহণ করল। তার শাসনামলে ফেতনা দূরভীত হলো। তিনি তার গভর্নরদের নিকট চিঠি পাঠান:
এখন কেউ ‘খলকে কুরআন’-এর চর্চা করবে না।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহিমহুল্লাহ) ২৪১ হিজরি সনে তার নিজ শহর বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়।