নাম: মুহাম্মদ আবদুল হক। পিতা: মরহুম মৌলভী আবদুল গনি (রহ.)। জন্ম: তিনি মোমেনশাহী জেলার কোতোয়ালি থানাধীন বোররচর ইউনিয়ন, কুষ্টিয়াপাড়া গ্রামে ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁরা পাঁচ ভাই, পাঁচ বোন, ভাই বোনের মাঝে তিনি দ্বিতীয়।
শিক্ষাজীবন:
আল্লামা আবদুল হক (হাফি.) প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে, সেখানে অত্যন্ত সুনামের সাথে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তিনি সব সময় ফাস্ট বয় থাকতেন। প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালীন সময়ে নোয়াখালী নিবাসী তাঁর একজন শিক্ষক জনাব সিদ্দিক আহমদ সাহেবের কাছে স্কুলে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কায়দায়ে বোগদাদী ও কোরআনের কিছু সূরা পড়েন।
পরবর্তীতে স্থানীয় মাদরাসার শিক্ষক জনাব ক্বারী আবদুল ওয়াহেদ সাহেবের কাছে আমপারার কিয়দাংশ (সূরা বালাদ) পর্যন্ত তাজবীদের সাথে পাঠ করেন। ছোট কাল থেকেই মাদরাসায় পড়ার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল, সেই আগ্রহ ও স্বপ্ন নিয়ে বড় হতে থাকেন। সে সুবাদে তার পিতা তাকে মাদরাসায় হিফজ খানায় ভর্তি করিয়ে দেন।
বালিয়া মাদরাসায় প্রথমে হিফজ খানায় পড়েন। পরে অসুস্থ হয়ে গেলে পিতার পরামর্শে চলে আসেন মোমেনশাহী বড় মসজিদে হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.)-এর কাছে।
হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ. তার তেলাওয়াত শুনে অনেক খুশি হন এবং তার কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে যান। তাঁকে অনেক আদর করতেন। কথায় কথায় “আমার আবদুল হক” বলে সম্বোধন করতেন। নিজের পুত্রের চেয়েও বেশি মুহাব্বত করতেন। কখনও বলতেন “আবদুল হক আমার ছেলে।”
বাসায় কোন খাবার তৈরি হলে তাঁকে বাসায় নিয়ে খাওয়াতেন। তিনি বড় মসজিদে দুই বৎসর অত্যন্ত সুনামের সাথে অধ্যয়ন করেন এবং এখানেই কুরআনুল কারীমের হিফজ সম্পন্ন করেন। এরপর হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহ.)-এর সুবহতে থাকার জন্য হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.) তাঁকে কিশোরগঞ্জ জামিয়া এমদাদিয়ায় ভর্তি করিয়ে দেন।
সেখানে তিনি নাহবেমীর জামাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগ মাদরাসায় হেদায়াতুন্নাহব ও কাফিয়া জামাত পড়েন। এরপর বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উম্মুল মাদারিস দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় শরহে জামী জামাতে ভর্তি হন।
এখানে ভর্তি হতে না হতেই সকলের কাছে প্রিয় পাত্র হয়ে যান এবং উস্তাদরা সকলে মিলে তাঁকে মাদরাসা মসজিদে জাহ্রী নামাজের ইমাম বানিয়ে দেন। বৎসরের শেষ পর্যন্ত তিনি ইমামতি করেন। তখনও তাঁর মুখে দাড়ি গজায়নি। এখানে তিনি এক বত্সর অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে অধ্যয়ন করেন।
স্বাস্থ্যগত কারণে হাটহাজারী মাদরাসা ছেড়ে পুনরায় ঢাকার জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগ মাদরাসায় চলে আসেন। এখানে শরহে বেকায়া এবং জালালাইন পড়েন, তিনি যে বত্সর জালালাইন জামাত পড়লেন ঐ সময় বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের প্রায় মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে তিনি বাড়িতে কিছুদিন অবসর সময় পার করছিলেন।
ফলে তিনি চিন্তা করলেন এভাবে অবসর সময় নষ্ট না করে হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে যাওয়াটা ভালো হবে। এ বিষয়ে তিনি পূর্ণ দুই সপ্তাহ ইস্তিখারা করেন। এতে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার রায় পান। তাই তিনি তালদীঘি হাই স্কুলে নবম শ্রেণীতে সাইন্সের ক্লাসে ভর্তি হন।
যদিও তিনি দশ বছর পূর্বে মাত্র প্রাইমারী পর্যন্ত পড়েছিলেন। তথাপি কৃতি ছাত্র হিসেবে নবম শ্রেণীতে সাইন্সের ক্লাসে ভর্তি হওয়া ও সারা বছর কৃতিত্বের সাথে ক্লাস চালিয়ে যাওয়া তার কোনো কঠিন ব্যাপার ছিল না।
এখানে অত্যন্ত সুনামের সাথে প্রায় দুই বছর পড়াশোনা করেন। হাই স্কুলের জীবনে তার মেধাবলে বাংলা, ইংরেজি, অংক, ম্যাথমেটিক্স সকল বিষয়ে সেরা ছাত্রদেরকেও হার মানিয়েছেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা ও আচার-ব্যবহারে সকল শিক্ষক ও ছাত্রদের কাছে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে যায়। তার একজন শিক্ষক ছিলেন জনাব নরেশ চন্দ্র বাবু (বিএসসি স্যার), তিনি বলতেন আমি জীবনে একজন ছাত্র কামাই করেছি তিনি হলেন বড় মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল হক।
এরপর যখন আবার মাদরাসা সমূহের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হল তখন তিনি আবার মাদরাসায় চলে যান এবং লালবাগ মাদরাসা থেকেই দাওরায়ে হাদীস অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে সমাপ্ত করেন। আল্লামা আবদুল হক (হাফি.) লালবাগ মাদরাসার শুরু থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত সব জামাতের সকল পরীক্ষায় তিনি নিজ জামাতে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।
কর্মজীবন:
আল্লামা আবদুল হক (হাফি.) কওমী মাদরাসার নিচের জামাত থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত প্রায় সমস্ত কিতাব অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষা দান করেন।
তাঁর শিক্ষকতার সুনাম অদ্যাবধি সর্বত্র বিদ্যমান। কামরাঙ্গীরচর মাদরাসায় বুখারী, তিরমিযী সহ হাদিসের কিতাবাদির দরস প্রদান করেন। ১৯৮৭ সনে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর কামরাঙ্গীরচর মাদরাসা ছেড়ে চলে আসেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া মাদরাসায়।
এখানে তিনি সাড়ে তিন বৎসর অত্যন্ত সুনামের সাথে হাদিসের কিতাবাদি সহ বিভিন্ন কিতাবাদির দরস প্রদান করেন। হযরত মাওলানা মুহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ (রহ.)-এর নির্দেশে পাশের মসজিদে ইমাম ও খেতাবতের দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর তার প্রাণপ্রিয় উস্তাদ ও শায়েখ হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.), যিনি মোমেনশাহী বড় মসজিদে অত্যন্ত সুনামের সাথে ৫৬ বৎসর যাবত ইমাম ও খেতাবতের দায়িত্ব পালন করেন। তার নির্দেশে চলে আসেন মোমেনশাহীর বড় মসজিদে। প্রায় ৩২ বৎসরের অধিক সময় যাবৎ ইমাম ও খেতাবতের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
তিনি মোমেনশাহীতে আসার পর ইমামতি ও খেতাবতের এর পাশাপাশি মোমেনশাহীর ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ চরপাড়া জামিয়া ইসলামিয়ায় দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় মাদরাসার নিচের জামাত থেকে দাওরা হাদীসের বুখারী শরীফের দরস অত্যন্ত সুনামের সাথে প্রদান করেন।
এমনিভাবে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলুম মাদরাসায় ১৬ বৎসর পর্যন্ত বুখারী শরীফের দরস প্রদান করেন। শিকারীকান্দা মাদরাসায় তিন বৎসরকাল বুখারী শরীফের দরস প্রদান করেন। এরপর ২০০৫ সালে তিনি মোমেনশাহী বড় মসজিদের আঙিনায় জামিয়া ফয়জুর রহমান রহ. মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
এই মাদরাসা থেকে হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.)-এর মত মানুষ গড়ে উঠতে তার নামে মাদরাসার নামকরণ করেন। বর্তমানে সারা বাংলাদেশে এই মাদরাসা শিক্ষা ও আমলের দিক দিয়ে এর সুনাম শীর্ষে রয়েছে। অদ্যাবধি আল্লামা আবদুল হক (হাফি.) এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, মহাপরিচালক ও শাইখুল হাদীস হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।
অন্যান্য খেদমত:
বর্তমানে আল্লামা আবদুল হক (হাফি.) মাদরাসা ও মসজিদের খেদমতের পাশাপাশি দ্বীনী ও সামাজিক কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় দিন প্রচারের কাজ করে যাচ্ছেন। আল্লাহ ভোলা মানুষকে আল্লাহ-মুখী করার চেষ্টা অব্যাহত রখেছেন আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে। খাঁটি মানুষ তৈরি করার সাধনাও অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
মোমেনশাহী জেলার চায়নামোড় নামক স্থানে ঐতিহ্যবাহী দাওয়াতুল হক কওমি মাদরাসা নামে আরেকটি সুনামধন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বুখারী শরীফের দরস প্রদান করেন। সপ্তাহে একদিন কিশোরগঞ্জ জেলার তারাপাশা মাদরাসায়, আরেকদিন গাজীপুর মাওনা মাদরাসায় এবং সপ্তাহে একদিন আকুয়া মড়ল বাড়ি মাদরাসায় ও মাসে একদিন গাজীপুর কাশেমপুর মাদরাসায় বুখারী শরীফের দরস দান করেন। তাছাড়া বহুমুখী দ্বীনি কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
আধ্যাত্মিক সাধনা:
ছোটবেলা থেকেই আল্লামা আবদুল হক (হাফি.) আধ্যাত্মিক সাধনায় মনোযোগী হন। পড়াশোনার শুরু যমানা থেকেই আল্লাহওয়ালা উস্তাদগন এর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। বালিয়া মাদরাসায় পড়া অবস্থায় হযরত মাওলানা লোকমান (রহ.) ও হযরত মাওলানা দৌলত আলী (রহ.)-এর সংস্পর্শ লাভ করেন।
বড় মসজিদের হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তার কাছেই হিফজ সম্পন্ন করেন। কিতাব বিভাগের শুরু যামানায় হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহ.) ও তদীয় প্রধান খলীফা হযরত মাওলানা আহমদ আলী খান সাহেব (রহ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন।
হিদায়াতুন্নাহু পড়াকালীন সময়ে থেকেই হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.)-এর খলীফা হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহাব সাহেব (রহ.)-এর কাছে এছলাহী চিঠির আদান প্রদান করেন।
শরহে জামীর জামাত হাটহাজারীতে পড়েন। ঐ সময় হযরত মুহতামিম (রহ.) ও হযরত মুফতি ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন। এরপর হযরত মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.), হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ও হযরত মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ (রহ.)-এর স্নেহ ও সান্নিধ্য লাভ করেন।
হযরত হাফেজ্জী হুযুর (রহ.), হযরত ক্বারী সিদ্দিকুর রহমান (রহ.), হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.) ও শাহাতলীর পীর সাহেব (রহ.) প্রমুখ বুজুর্গানে দ্বীন তাকে খেলাফত প্রদান করেন।
আল্লামা আবদুল হক (হাফি.) নিরসলভাবে এসলাহে খলকের দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আল্লাহ পাক তাঁকে সুস্থতার সাথে হায়াতে তাইয়িবা দান করুন। আমীন।