মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. মদিনায় আগমন করার পর বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হোন। একদিকে কুরাইশদের চক্রান্ত, মদিনায় লোক পাঠিয়ে হিজরতকারী সাহাবীদেরকে গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা; মদিনার ইহুদিদের অপকৌশল; অপরদিকে মুসলমানদের ভেতর অনুপ্রবেশকারী মুনাফিকদের দুরভীসন্ধি। মুনাফিকদের স্বভাব ছিল: ইহুদিদের সাথে মিলিত হয়ে মুসলমানদের মাঝে ভাঙন তৈরি করা, বিভিন্ন মিথ্যা অপবাদ রটানো এবং দুর্বল ব্যক্তিদেরকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে আনা। তারা প্রকাশ্যে নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করত আর অন্তরে ইসলামের ব্যাপারে বিদ্বেষ লালন করত।
তাদের ষড়যন্ত্র থেকে বাদ যায় নি বড় বড় সাহাবাগণও। তাদের অপবাদের শিকার হতে হয়েছিল হযরত আয়েশা রা. কে। তিনি ইফকের ঘটনার সময়টুকু ধৈর্য ধারণ করেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা হযরত আয়েশা রা.-এর ব্যাপারে আয়াত নাজিল করে তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করেন।
ইফকের ঘটনার বিবরণ
ইফকের ঘটনার বিবরণ স্বয়ং হযরত আয়েশা রা. এভাবে বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন সফরের ইচ্ছা করতেন তখন তিনি তাঁর স্ত্রীগণের (নামের জন্য) কোরা (লটারি) ব্যবহার করতেন। এতে যার নাম আসত তাকেই তিনি সাথে করে সফরে বের হতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, এমনি এক যুদ্ধে (মুরায়সীর যুদ্ধ) তিনি আমাদের মাঝে কোরা ব্যবহার করেন এবং এতে আমার নাম বেরিয়ে আসে। তাই আমিই রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে সফরে বের হলাম। এ ঘটনাটি পর্দার হুকুম নাজিল হওয়ার পর সংঘটিত হয়েছিল। তখন আমাকে হাওদাজ সহ সওয়ারিতে উঠানো ও নামানো হত। আমরা চলতে থাকলাম। অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন এ যুদ্ধ থেকে অবসর হলেন, তখন তিনি (বাড়ির দিকে) ফিরলেন।
ফেরার পথে আমরা মদীনার নিকটবর্তী হলে তিনি একদিন রাতের বেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। রওয়ানা হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর আমি উঠে (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য) পায়ে হেঁটে সেনা ছাউনি অতিক্রম করে (একটু সামনে) গেলাম। এরপর প্রয়োজন সেরে আমি আমার সওয়ারির কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখলাম যে, (ইয়ামানের অন্তর্গত) যিফার শহরের পুতি দ্বারা তৈরি করা আমার গলার হারটি ছিঁড়ে কোথাও পড়ে গিয়েছে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আমার হারটি তালাশ করতে আরম্ভ করলাম। হার তালাশ করতে করতে আমার আসতে বিলম্ব হয়ে যায়।
আয়েশা (রা.) বলেন, যে সমস্ত লোক উটের পিঠে আমাকে উঠিয়ে দিতেন তারা এসে আমার হাওদাজ উঠিয়ে তা আমার উটের পিঠে তুলে দিলেন যার উপর আমি আরোহণ করতাম। তারা মনে করেছিলেন যে, আমি এর মধ্যেই আছি, কারণ খাদ্যাভাবে মহিলাগণ তখন খুবই হালকা পাতলা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দেহে গোশত বহুল ছিল না। তাঁরা খুবই স্বল্প পরিমাণে খাবার খেতে পেত। তাই তারা যখন হাওদাজ উঠিয়ে উপরে রাখেন তখন তা হালকা হওয়ায় বিষয়টিকে কোনো প্রকার অস্বাভাবিক মনে করেননি। অধিকন্তু আমি ছিলাম একজন অল্প বয়স্কা কিশোরী।
এরপর তারা উট হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সৈন্যদল রওয়ানা হওয়ার পর আমি আমার হারটি খুঁজে পাই এবং নিজস্ব স্থানে ফিরে এসে দেখি; তাঁদের (সৈন্যদের) কোনো আহ্বায়ক এবং কোনো উত্তরদাতা তথায় নেই। (নিরুপায় হয়ে) তখন আমি পূর্বে যেখানে ছিলাম সেখানে বসে রইলাম। ভাবছিলাম, তাঁরা আমাকে দেখতে না পেলে অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে।
ঐ স্থানে বসে থাকা অবস্থায় ঘুম চেপে আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বনু সুলামী গোত্রের যাকওয়ান শাখার সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল (রা.) [যাকে রাসূলুল্লাহ (সা.) ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র কুড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।] সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিলেন। তিনি প্রত্যুষে আমার অবস্থানস্থলের কাছে পৌঁছে একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে আমার দিকে তাকানোর পর আমাকে চিনে ফেললেন। পর্দার বিধান নাজিল হওয়ার পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন।
তিনি আমাকে চিনতে পেরে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়লে আমি তা শুনতে পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং চাঁদর টেনে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি। আল্লাহর কসম! আমি আর কথা বলিনি এবং তাঁর থেকে ইন্নালিল্লাহ …. পাঠ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাইনি।
এরপর তিনি সওয়ারি থেকে অবতরণ করলেন এবং সওয়ারীকে বসিয়ে তার সামনের পা নীচু করে দিলে আমি গিয়ে তাতে আরোহণ করলাম। পরে তিনি আমাকে সহ সওয়ারীকে টেনে আগে আগে চলতে লাগলেন, পরিশেষে ঠিক দ্বিপ্রহরে প্রচণ্ড গরমের সময় আমরা গিয়ে সেনাদলের সাথে মিলিত হলাম। সে সময় তাঁরা একটি জায়গায় অবস্থান করছিলেন।
আয়েশা (রা.) বলেন, এরপর যাদের ধ্বংস হওয়ার ছিল তারা (আমার প্রতি অপবাদ আরোপ করে) ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এ অপবাদ আরোপের ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সে হল: আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল।
এ প্রসঙ্গে উরওয়া (রা.) আরো বর্ণনা করেন: অপবাদ আরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হাসান ইবনে সাবিত, মিসতাহ ইবনে উসাসা এবং হামনা বিনতে জাহাশ (রা.) ব্যতীত আর কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা গুটিকয়েক ব্যক্তির একটি দল ছিল, এতটুকু ব্যতীত তাদের সম্পর্কে আমার আর কিছু জানা নেই…
হযরত উরওয়া (রা.) বলেন: আয়েশা (রা.)-এর ব্যাপারে হাসান ইবনে সাবিত (রা.)- কে গালমন্দ করাকে পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, হাসান ইবনে সাবিত তো ঐ ব্যক্তি যিনি তার এক কবিতায় বলেছেন, আমার মান সম্মান এবং আমার বাপ দাদা মুহাম্মাদ (সা.)- এর মান সম্মান রক্ষায় নিবেদিত।
আয়েশা (রা.) বলেন: এরপর আমরা মদিনায় আসলাম। মদিনায় আগমন করার পর একমাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ থাকলাম। এদিকে অপবাদ রটনাকারীদের কথা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা ও চর্চা হতে লাগলো। কিন্তু এসবের কিছুই আমি জানি না। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছিল এবং তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল আমার এ অসুখের সময়। কেননা এর পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে যেরূপ স্নেহ- ভালবাসা লাভ করতাম আমার এ অসুখের সময় তা আমি পাচ্ছিলাম না।
তিনি আমার কাছে এসে সালাম করে কেবল “তুমি কেমন আছো” জিজ্ঞাসা করে চলে যেতেন। তাঁর এ আচরণই আমার মনে চরম সন্দেহের উদ্রেক করে। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাইরে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ জঘন্য অপবাদ সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না…
(সে সময়) প্রকৃতির ডাকে আমাদের বের হওয়ার অবস্থা এই ছিলে যে, এক রাতে বের হলে আমরা আবার পরের রাতে বের হতাম। এ ছিল আমাদের ঘরের পার্শ্বে শৌচাগার তৈরি করার পূর্বের ঘটনা। আমাদের অবস্থা প্রাচীন আরবীয় লোকদের অবস্থার মত ছিল। তাদের মত আমরাও শৌচাগার করার জন্য ঝোপঝাড়ে চলে যেতাম। এমনকি (অভ্যাস না থাকার কারণে) বাড়ির পার্শ্বে শৌচাগার তৈরি করলে আমরা খুব কষ্ট পেতাম।
একদা আমি এবং উম্মে মিসতাহ একত্রে বের হলাম। আমরা আমাদের কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে উম্মে মিসতাহ তার কাপড়ে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বললেন: মিসতাহ ধ্বংস হোক! আমি তাকে বললাম, আপনি খুব খারাপ কথা বলেছেন। আপনি কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছেন? তিনি আমাকে বললেন, ওগো অবলা! সে তোমার সম্পর্কে কি বলে বেড়াচ্ছে তুমি তো তা শোনোনি। আয়েশা (রা.) বলেন: আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে আমার সম্পর্কে কি বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকারীদের কথাবার্তা সম্পর্কে আমাকে জানালেন।
এরপর আমার রোগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাড়ি ফেরার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার কাছে আসলেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেমন আছো?
আয়েশা (রা.) বলেন, আমি আমার পিতামাতার কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)- কে বললাম আপনি কি আমাকে আমার পিতামাতার কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিবেন? আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে অনুমতি দিলেন। তখন (বাড়িতে গিয়ে) আমি আমার আম্মাকে বললাম: আম্মাজান! লোকজন কি আলোচনা করছে?
তিনি বললেন: বেটি! এ বিষয়টিকে হালকা করে ফেল। আল্লাহর কসম! সতিন আছে এমন স্বামী সোহাগিণী সুন্দরী রমণীকে তাঁর সতিনরা বদনাম করবে না, এমন খুব কমই হয়ে থাকে।
আয়েশা (রা.) বলেন, আমি বিস্ময়ের সাথে বললাম, সুবাহানাল্লাহ! লোকজন কি এমন গুজবই রটিয়েছে।
আয়েশা (রা.) বলেন: রাতভর আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে ভোর হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার অশ্রুও বন্ধ হল না এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। এরপর ভোরবেলাও আমি কাঁদছিলাম। তিনি আরো বলেন যে, এ সময় ওহি নাজিল হতে বিলম্ব হলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তার স্ত্রীর (আমার) বিচ্ছেদের বিষয়টি সম্পর্কে পরামর্শ ও আলোচনা করার নিমিত্তে আলী ইবনে আবু তালিব এবং উসামা ইবনে যায়দ (রা.)- কে ডেকে পাঠালেন। আয়েশা (রা.) বলেন: উসামা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর স্ত্রীদের পবিত্রতা এবং তাদের প্রতি (নবিজির) ভালোবাসার কারণে বললেন, (হে আল্লাহর রাসূল) তাঁরা আপনার স্ত্রী, তাদের সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না।
আর আলী (রা.) বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তো আপনার জন্য সংকীর্ণতা রাখেননি। তাঁকে (আয়েশা) ব্যতীত আরো বহু মহিলা রয়েছে। তবে আপনি এ ব্যাপারে দাসী [বারীরা (রা.)]- কে জিজ্ঞাসা করুন। সে আপনার কাছে সত্য কথাই বলবে। আয়েশা (রা.) বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বারীরা (রা.)-কে ডেকে বললেন: হে বারীরা! তুমি তাঁর মধ্যে কোনো সন্দেহমূলক আচরণ দেখেছ কি? বারীরা (রা.) তাঁকে বললেন: সেই আল্লাহর শপথ, যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন; আমি তার মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখিনি যার দ্বারা তাঁকে দোষী বলা যায়। তবে তাঁর ব্যাপারে শুধু এতটুকু বলা যায় যে, তিনি হলেন অল্প বয়স্কা যুবতী মেয়ে; রুটি তৈরি করার জন্য আটা খামির করে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। আর বকরি এসে অমনি তা খেয়ে ফেলে।
আয়েশা (রা.) বলেন, (এ কথা শুনে) সেদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) সাথে সাথে উঠে গিয়ে মিম্বরে বসে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর ক্ষতি থেকে রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়! যে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অপবাদ ও বদনাম রটিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার এ অপবাদ থেকে আমাকে কে মুক্ত করবে? আল্লাহর কসম, আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। তাঁরা (অপবাদ রটনাকারীরা) এমন এক ব্যক্তির (সাফওয়ান ইবনে মু‘আত্তাল) নাম উল্লেখ করছে যার সম্বন্ধেও আমি ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না। সে তো আমার সাথেই আমার ঘরে যায়।
(এ কথা শুনে) বনী আব্দুল আশহাল গোত্রের সা‘দ (ইবনে মুআয) (রা.) উঠে বললেন: ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আপনাকে এ অপবাদ থেকে মুক্তি দেব। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তা হলে তার শিরশ্ছেদ করব। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজের লোক হয় তাহলে তার ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই পালন করব।
আয়েশা (রা.) বলেন: এ সময় হাসসান ইবনে সাবিত (রা.)- এর মায়ের চাচাতো ভাই খাযরাজ গোত্রের সর্দার সাঈদ ইবনে উবাদা (রা.) দাঁড়িয়ে এ কথার প্রতিবাদ করলেন। আয়েশা (রা.) বলেন: এ ঘটনার পূর্বে তিনি একজন সৎ এবং নেককার লোক ছিলেন। কিন্তু (এসময়) গোত্রীয় অহমিকায় উত্তেজিত হয়ে তিনি সা‘দ ইবনে মু‘আয (রা.)- কে বললেন: তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আল্লাহর কসম, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না এবং তাকে হত্যা করার ক্ষমতাও তোমার নেই। যদি সে তোমার গোত্রের লোক হত তাহলে তুমি তার হত্যা হওয়া কখনো পছন্দ করতে না। তখন সা‘দ ইবনে মু‘আয (রা.)- এর চাচাতো ভাই উসাঈদ ইবনে হুযাইর (রা.) সা‘দ ইবনে ওবায়দা (রা.)- কে বললেন, বরং তুমিই মিথ্যা কথা বললে। আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি হলে মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ অবলম্বন করে কথা বলছ।
আয়েশা (রা.) বলেন, এসময় আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে। এমনকি তারা যুদ্ধের সংকল্প পর্যন্ত করে বসে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) মিম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের থামিয়ে শান্ত করলেন এবং নিজেও চুপ হয়ে গেলেন।
আয়েশা (রা.) বলেন, আমি সেদিন সারাক্ষণ কেঁদে কাটালাম। অশ্রুঝরা আমার বন্ধ হয়নি এবং একটু ঘুমও আমার আসেনি। আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার পিতা-মাতা আমার পার্শ্বে বসা ছিলেন। এমনি করে একদিন দুই রাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দেই। এর মাঝে আমার কোনো ঘুম আসেনি। বরং অবারিত ধারায় আমার চোখ থেকে অশ্রুপাত হতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন, কান্নার ফলে আমার কলিজা ফেটে যাবে।
আমি ক্রন্দনরত ছিলাম আর আমার আব্বা-আম্মা আমার পাশে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় একজন আনসারী মহিলা আমার কাছে আসার অনুমতি চাইলে আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। সে এসে বসল এবং আমার সাথে কাঁদতে আরম্ভ করল। তিনি বলেন, আমরা ক্রন্দনরত ছিলাম ঠিক এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের কাছে এসে সালাম করলেন এবং আমাদের পাশে বসে গেলেন।
আয়েশা (রা.) বলেন: অপবাদ রটানোর পর আমার কাছে এসে এভাবে তিনি আর কখনো বসেননি। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) দীর্ঘ একমাস অপেক্ষা করার পরও আমার বিষয়ে তাঁর নিকট কোনো ওহি আসেনি।
বসার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) কালিমা শাহাদাত পাঠ করলেন। এরপর বললেন, যা হোক আয়েশা তোমার সম্বন্ধে আমার কাছে অনেক কথাই পৌঁছেছে, যদি তুমি এর থেকে মুক্ত হও তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তোমাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করে দেবেন। আর যদি তুমি কোনো গুনাহ করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাওবা কর। কেননা বান্দা গুনাহ স্বীকার করে তওবা করলে আল্লাহ তাআলা তওবা কবুল করেন।
আয়েশা (রা.) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) তার কথা বলে শেষ করলে আমার অশ্রুপাত বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এক ফোঁটা অশ্রুও আমি আর অনুভব করলাম না। তখন আমি আমার আব্বাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ (সা.) যা বলেছেন আমার পক্ষ থেকে আপনি তার জবাব দিন।
তখন আমার আব্বা বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূল (সা.)- কে কী জবাব দিব আমি তা জানি না। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, রাসূল (সা.) যা বলেছেন আমার পক্ষ থেকে আপনি তার জবাব দিন। তখন আমার আম্মা বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূল (সা.)- কে কি জবাব দিব আমি তা জানি না। তখন আমি ছিলাম অল্প বয়স্কা কিশোরী। কুরআনও বেশী পড়তে পারতাম না। তথাপিও এ অবস্থা দেখে আমি নিজেই বললাম, আমি জানি আপনারা এ অপবাদের ঘটনা শুনেছেন, আপনারা তা বিশ্বাস করেছেন এবং বিষয়টি আপনাদের মনে সুদৃঢ় হয়ে আছে। এখন যদি আমি বলি যে, এর থেকে আমি পবিত্র এবং আমি নিষ্কলুষ তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এ অপরাধের কথা স্বীকার করে নেই যা সম্পর্কে আমার আল্লাহ জানেন যে, আমি এর থেকে পবিত্র, তাহলে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন।
আল্লাহর কসম, আমি ও আপনারা যে অবস্থার স্বীকার হয়েছি এর জন্য (নবি) ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)- এর পিতার কথার উদাহরণ ব্যতীত আমি আর কোনো উদাহরণ খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন: “সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ, সে বিষয়ে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল।”
এরপর আমি মুখ ফিরিয়ে আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আল্লাহ তাআলা জানেন যে, সে মূহুর্তেও আমি পবিত্র। অবশ্যই আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন (এ কথার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল) তবে আল্লাহর কসম, আমি কখনো ধারণা করিনি যে, আমার ব্যাপারে আল্লাহ ওহি নাজিল করবেন যা পঠিত হবে। আমার ব্যাপারে আল্লাহ কোনো কথা বলবেন আমি নিজেকে এতখানি যোগ্য মনে করিনি বরং আমি নিজেকে এর চেয়ে অধিক অযোগ্য বলে মনে করতাম। তবে আমি আশা করতাম যে, হয়তো রাসূলুল্লাহ (সা.)- কে এমন স্বপ্ন দেখানো হবে যার দ্বারা আল্লাহ আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন।
আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সা.) তখনো তাঁর বসার জায়গা ছাড়েননি এবং ঘরের লোকদের থেকেও কেউ ঘর থেকে বাইরে যাননি। এমতাবস্থায় তাঁর উপর ওহি নাজিল হতে শুরু হল। ওহি নাজিল হওয়ার সময় তাঁর যে বিশেষ কষ্ট হত তখনও সে অবস্থা তাঁর হল। এমনকি প্রচণ্ড শীতের দিনেও তাঁর দেহ থেকে মোতির দানার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ত ঐ বাণীর গুরুভারের কারণে, যা তাঁর প্রতি নাজিল করা হয়েছে।
আয়েশা (রা.) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর এ অবস্থা দূরীভূত হলে তিনি হাসিমুখে প্রথমে যে কথাটি বললেন তা হলো: হে আয়েশা! আল্লাহ তোমার পবিত্রতা জাহির করে দিয়েছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, এ কথা শুনে আমার আম্মা আমাকে বললেন, তুমি উঠে রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি এখন তাঁর দিকে উঠে যাব না। মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কারো প্রশংসা আমি করব না।
আয়েশা রা.-এর পবিত্রতার ব্যাপারে আয়াত
ইফকের ঘটনার প্রেক্ষিতে হযরত আয়েশা রা.-এর পবিত্রতার ব্যাপারে আল্লাহ তায়লা ১০টি আয়াত নাজিল করেন। হযরত আয়েশা (রা.) বললেন: আল্লাহ (আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে) যে দশটি আয়াত নাজিল করেছেন, তা হলো এই –
“যারা এ অপবাদ রটনা করেছে তারা তো তোমাদেরই একটা দল; এ ঘটনাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছে কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মু’মিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি, এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ। তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাবাদী। দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত। যখন তোমরা মুখে মুখে এ মিথ্যা ছাড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিলনা এবং একে তোমরা তুচ্ছ ব্যাপার বলে ভাবছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল খুবই গুরুতর ব্যাপার। এবং এ কথা শোনামাত্র তোমরা কেন বললে না যে, এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদের জন্য উচিত নয়। আল্লাহ পবিত্র, মহান! এ তো এক গুরুতর অপবাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো তাহলে কখনো অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি করবে না, আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেত না। আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। – [আল কুরআন ২৪: ১১-২০]
এরপর আমার পবিত্রতা ঘোষণা করে আল্লাহ এ আয়াতগুলো নাজিল করলেন। আত্মীয়তা এবং দারিদ্রের কারণে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মিসতাহ ইবনে উসাসা কে আর্থিক ও বৈষয়িক সাহায্য করতেন। কিন্তু আয়েশা (রা.) সম্পর্কে তিনি যে অপবাদ রটিয়েছিলেন এ কারণে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কসম করে বললেন, আমি আর কখনো মিসতাহকে আর্থিক কোনো সাহায্য করব না।
তখন আল্লাহ তাআলা নাজিল করলেন- “তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্থকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদের কে কিছুই দিবে না। তারা যেন তাদের কে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। শোন! তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের কে ক্ষমা করেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল; পরম দয়ালু!” [আল কুরআন ২৪: ২২]
(এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর) আবু বকর সিদ্দীক (রা.) বলে উঠলেন: হ্যাঁ, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি পছন্দ করি যে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিন। এরপর তিনি মিসতাহ (রা.)- এর জন্য যে অর্থ খরচ করতেন তা পুনঃ দিতে আরম্ভ করলেন এবং বললেন: আল্লাহর কসম! আমি তাকে এ অর্থ দেওয়া আর কখনো বন্ধ করব না।
আয়েশা (রা.) বলেন, আমার এ বিষয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) যায়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) কেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি যায়নাব (রা.)- কে বলেছিলেন, তুমি আয়েশা (রা.) সম্পর্কে কী জানো অথবা বলেছিলেন তুমি কি দেখেছ? তখন তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আমার চোখ এবং কানকে সংরক্ষণ করেছি। আল্লাহর কসম! আমি তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না।
আয়েশা (রা.) বলেন: নবি কারীম (সা.)- এর স্ত্রীগণের মধ্যে তিনি আমার সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে আল্লাহ ভীতির ফলে রক্ষা করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, অথচ তাঁর বোন হামনা (রা.) তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে অপবাদ রটনাকারীদের মত অপবাদ রটনা করে বেড়াচ্ছিলেন। ফলে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্তদের সাথে ধ্বংস হয়ে গেলেন।
শেষ কথা,
ইফকের ঘটনার পুরো বিবরণ সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে। পাঠকগণ এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চাইলে সহিহ বুখারীর পরিচ্ছেদ: ২১৯৮ (باب حَدِيثُ الإِفْكِ الإِفْك وَالأَفَكِ) দেখতে পারেন