ইমাম আবু হানিফা রহ. ছিলেন একজন ফকিহ, মুজতাহিদ, মুহাদ্দিস এবং স্বীয় জমানার শ্রেষ্ঠ ইমাম। শিক্ষা জীবনীর শুরুর দিকে তিনি ইলমুল কালাম শিক্ষায় কাটান। পরবর্তীতে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি ইলমুল কালাম থেকে হাদিস এবং ফিকহের জ্ঞান অর্জনে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেন। তাকে ’ইমামুল আজম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি কুফাতে বসবাস করতেন।
ইমাম আবু হানিফার জন্ম ও মৃত্যু:
ইমাম আবু হানিফা রহ. ৮০ হিজরী মোতাবেক ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রসিদ্ধ নগরী বাগদাদে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৫০ হিজরী মোতাবেক ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেন। ইলমি দিক থেকে কুফা ছিল সে সময়ের প্রসিদ্ধ একটি শহর ছিল।
আল্লামা কাউসারি রহ, ‘নাসবুর রায়া’র ভূমিকাতে বলেন:
কুফা একটি ইসলামি শহর। ১৭ হিজরিতে খলিফা উমর রা.-এর জামানায় তার নির্দেশে শহরটি নির্মাণ করা হয়। তার আশপাশে ফাসীহ আরবগণ বাস করতেন। সেখানকার শিক্ষা-দীক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে প্রেরণ করা হয়। তার ইলমি যোগ্যতা এর মাধ্যমে আন্দাজ করা যেতে পারে যে, উমর রা. কুফাবাসীকে লেখেন, ইবনে মাসউদকে আমার নিজের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু আমি তোমাদের প্রয়োজনকে অগ্রগণ্য মনে করে তোমাদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য তাকে প্রেরণ করছি।
তিনি কুফাতে উসমান রা.-এর খেলাফতকালের শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের কুরআন ও দ্বীনি মাসআলা-মাসায়েল শিক্ষা দিতে থাকেন। তার শিক্ষাদানের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। কতিপয় মুহাদ্দিসীনের বর্ণনামতে, সেই নবনির্মিত শহরে তার মাধ্যমে চার হাজার আলেম মুহাদ্দিস তৈরি হয়। এমনকি আলি রা. কুফায় প্রবেশকালে সেখানকার ইলমি অবস্থা দেখে বলে ওঠেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ইবনে মাসউদের কল্যাণ করুন। তিনি এ নগরীকে ইলম দ্বারা পূর্ণ করে দিয়েছেন।’
আলি রা.-এর আগমনে ইলমের শহর কুফার অবস্থা পূর্ণতার চূড়ায় পৌঁছে যায়। ইবনে আব্বাস রা.-এর ইলমের প্রতিচ্ছবি সাঈদ ইবনে জুবায়ের রহ.-ও কুফাতে ছিলেন। কেউ আলি রা.-এর কাছে ফাতাওয়া জিজ্ঞাসা করতে গেলে বলতেন, তোমাদের কাছে কি সাঈদ ইবনে জুবায়ের ছিল না? অর্থাৎ, সে থাকতে এখানে আসার কী প্রয়োজন ছিল।
রামাহুরমুজি রহ. আনাস ইবনে সিরিন থেকে বর্ণনা করেন, আমি কুফাতে গিয়ে চার হাজার হাদিস অন্বেষণকারী ছাত্র এবং চার হাজার ফকিহ পেয়েছি। হযরত আফফান ইবনে মুসলিম থেকে বর্ণিত, “আমরা কুফায় শুধু চার মাস অবস্থান করেছিলাম। সেখানে হাদিসের চর্চা এতটাই বেশি ছিল যে, আমরা চাইলে এ সময়ের মধ্যে এক লক্ষ হাদিস লিখতে পারতাম। কিন্তু আমরা শুধু পঞ্চাশ হাজার হাদিস লিপিবদ্ধ করি। জমহুরের কাছে গ্রহণযোগ্য হাদিসগুলোই আমরা গ্রহণ করি।”
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, হাদিস নেওয়ার জন্য হাদিস শাস্ত্রের ইমাম ও হাফেজদের জন্য কুফায় গমন আবশ্যক হয়ে পড়ে। আজও রিজাল শাস্ত্রের কিতাবগুলো খুললে হাজারো বর্ণনাকারী এমন পাওয়া যায়, যারা কুফা নগরীর ছিলেন; যাদের বর্ণনার মাধ্যমে বুখারি-মুসলিমসহ অন্যান্য কিতাব পূর্ণতা পেয়েছে।
ইমাম বুখারি রহ. বলেন: “আমি গণনা করে বলতে পারব না, হাদিস নেওয়ার জন্য কতবার কুফাতে গমন করেছি।”
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর পিতা:
ইমাম আবু হানিফার পিতার নাম: সাবেত। ১৬ বছর বয়সে তিনি স্বীয় পিতা সাবিতের সাথে হজ পালন করেন। তার পিতা সাবিত বিন যুতী আফগানিস্তানের কাবুলের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। পিতার বয়স যখন ৪০ বছর হলে আবু হানিফা জন্মগ্রহণ করেন।
ইমাম আবু হানিফার বংশ পরিচয়:
ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর বংশধারা এভাবে উল্লেখ করেন: “আবু হানিফা নুমান ইবনে সাবেত ইবনে যুতা ইবনে মাহ।” কিন্তু আবু হানিফা রহ.-এর নাতি তার নিজ দাদার বংশধারা এভাবে বর্ণনা করেন: ইসমাইল ইবনে হাম্মাদ ইবনে নুমান ইবনে সাবেত ইবনে নুমান ইবনে মারজুবান। সহিহ বর্ণনা মতে সর্বসম্মত বিষয়, ইমাম আবু হানিফার বাবা ইসলামের উপরই জন্মগ্রহণ করেন।
ইমাম সাহেবের নাতি ইসমাইল বর্ণনা করেন: আমাদের পরদাদা শৈশবকালে আলী রা.-এর খেদমতে উপস্থিত হয়েছিলেন। হযরত আলী রা. তার ও তার পরিবারের জন্য বরকতের দোয়া করেছিলেন। এর দ্বারা বুঝা যায়, আলী রা.-এর সাথে ইমামে আজম রহ.-এর পরিবারের বিশেষ সম্পর্ক ছিল এবং সে কারণেই তিনি সাবেত ও তার সন্তানাদির জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেছিলেন।
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর দৈহিক গঠন ও আখলাক:
খতিবে বাগদাদি রহ. আবু নুয়াইম রহ. থেকে বর্ণনা করেন: আবু হানিফা রহ. সুশ্রী ছিলেন। উত্তম পোশাক ও সুগন্ধি পছন্দ করতেন। মানুষের সাথে ওঠাবসা করতেন। স্বচ্ছ হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন; সাথি-সঙ্গীদের প্রতি ছিলেন দয়ার্দ্র।
হানাফী মাজহাবের অন্যতম ইমাম কাজী আবু ইউসুফ রহ., যিনি সমগ্র মুসলিম জাহানের প্রধান বিচারক ছিলেন; ইমাম আবু হানিফার দেহাবয়ব ও আখলাক সম্পর্কে বলেন: ‘ইমাম আবু হানিফা রহ. মাঝারি গড়নের ছিলেন; বেশি খাটোও ছিলেন না, আবার বেশি লম্বাও ছিলেন না। কথাবার্তা মিষ্ট, হৃদয়গ্রাহী কণ্ঠ ও কথায় বড় পটু ছিলেন।’
ইমাম আজম রহ.-এর দৌহিত্র বলেন: তিনি কিছুটা লম্বা ছিলেন। তার দেহের রং ছিল শ্যামলা বর্ণের। ভালো পোশাক পরিধান করতেন। সাধারণত ভালো অবস্থায় থাকতেন। সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। তার গমনাগমন সুগন্ধির মাধ্যমে আন্দাজ করা যেত।
কায়েস ইবনে রাবি বর্ণনা করেন, ইমাম সাহেব রহ. মাশায়েখ ও মুহাদ্দিসগণের কাছ থেকে কিছু অর্থকড়ি নিয়ে বাগদাদ থেকে পণ্য ক্রয় করতেন আর কুফায় নিয়ে বিক্রি করতেন। লভ্যাংশ নিজের কাছে রাখতেন। সেগুলোর মাধ্যমে মুহাদ্দিসদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেন। যা বেঁচে যেত তাদেরকে দিয়ে দিতেন এবং বলতেন, এগুলো নিজেদের প্রয়োজনে ব্যয় করুন এবং আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করুন। আমার শুকরিয়া আদায় করার প্রয়োজন নেই; কেননা এ মাল আমার পক্ষ থেকে দিইনি। এগুলো তোমাদেরই মালের লভ্যাংশ। আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি আমাকে তার মাধ্যম বানিয়েছেন।
হাসান ইবনে জিয়াদ রহ. বলেন, ‘ইমাম সাহেব মজলিসে একজনকে জীর্ণ পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখেন। তাকে বলেন: বসে যাও। মাহফিল শেষ হলে সে ব্যক্তি একা রয়ে যায়। ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন: জায়নামাজ উঠিয়ে তার নিচে যা আছে, তা নিয়ে নাও। জায়নামাজ উঠিয়ে দেখে তার নিচে এক হাজার দিরহাম। তিনি বলেন: এগুলো নিয়ে নাও। লোকটি বলল, আমি নিজে যথেষ্ট অর্থের মালিক। আমার এতে কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন: তবে নিজের অবস্থা এমন বানাও যে, তোমাকে দেখে যেন তোমার ভাই চিন্তিত না হয়। তুমি কি এ হাদিস জানো না, আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের উপর তার নেয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।’ [সিয়ারুস সাহাবা]
জাফর ইবনে আউন বর্ণনা করেন, ‘এক মহিলা আবু হানিফা রহ.-এর কাছে এসে একটি রেশমি কাপড় চায়। তিনি একটি কাপড় বের করে দেখান। মহিলা বলে, আমি এক বৃদ্ধা নারী। এটি আমানতের বিষয়। যা দিয়ে কিনেছেন তাই রাখুন। তিনি বলেন, চার দিরহাম দিন। মহিলাটি বলল, বুড়িকে হাসির পাত্র বানাবেন না; সঠিক দাম বলে দিন। ইমাম সাহেব রহ. বলেন: আমি দুটি কাপড় ক্রয় করেছিলাম। এক কাপড় থেকেই চার দিরহাম ছাড়া পুরো মূল্য উসুল হয়ে গেছে। তাই এটাকে চার দিরহামে বিক্রি করছি।’
অন্যতম ফকিহ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. সুফিয়ান সাওরি রহ.-কে বলেন, আবু হানিফা গিবত থেকে দূরে থাকেন; এমনকি নিজের শত্রুদের গিবত পর্যন্ত করেন না। সুফিয়ান সাওরি রহ. প্রতিউত্তরে বলেন, আবু হানিফা এর থেকে অনেক ঊর্ধ্বে যে, তিনি অপরকে নিজের নেকির হকদার বানাবেন (অর্থাৎ, যার গিবত করা হবে, কেয়ামতের দিন সে তার সওয়াব নিয়ে যাবে)।
ইমাম আজম রহ.-এর স্তর:
ইবনে খাল্লিকান রহ. বলেন, ইমাম আবু হানিফা রহ. চারজন সাহাবিকে পেয়েছেন। হযরত আনাস ইবনে মালেক ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা রা.-কে পেয়েছেন কুফাতে। সাহল ইবনে সাদ আস-সায়েদি রা.-কে মদিনাতে। আর আবু তুফায়েল আমের ইবনে ওয়াসেলা রা.-কে পেয়েছেন মক্কাতে। হাফেজ জাহাবি রহ. খোদ ইমাম সাহেব থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসুল সা.-এর সাহাবি আনাস ইবনে মালেক রা.-কে অনেকবার দেখেছেন। হাফেজ ইবনে হাজার রহ.- সহ অনেক হাদিস বিশারদ আনাস ইবনে মালেক রা.-কে দেখার বিষয়টি গ্রহণ করেছেন।
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর ইলম অর্জন:
একদা ইমামে আজম আবু হানিফা রহ. বলেন: প্রথমদিকে ইলমে কালামের প্রতি আমার অনেক আগ্রহ ছিল। এ ময়দানে আমি চূড়ায় পৌঁছে যাই। হাম্মাদ ইবনে আবু সুলাইমানের ইলমী মজলিস আমার কাছাকাছি ছিল। ঘটনাক্রমে এক দিন আমার কাছে এক মহিলা আসে। সে আমাকে একটি মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করে। মাসয়ালাটি হলো: এক লোকের স্ত্রী দাসী, সে তার স্ত্রীকে সুন্নাত অনুযায়ী তালাক দিতে চায়, কত তালাক দেবে?
আমি বুঝতে পারছিলাম না কী জবাব দেব। আমি বলি, হাম্মাদকে জিজ্ঞাসা করো। পরে আমাকেও জানাবে। সে হাম্মাদের কাছে যায়। তিনি বলেন, সে হায়েজ থেকে পবিত্র হওয়ার পর সহবাস করার পূর্বে এক তালাক দেবে। এরপর দুই হায়েজ অতিবাহিত হওয়ার পর দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারবে। সে ফিরে এসে আমাকে হাম্মাদের জবাব শোনায়।
আমি ভাবি, ইলমে কালাম তাহলে কোন কাজের! জুতা উঠিয়ে হাম্মাদের কাছে উপস্থিত হই। তিনি মাসয়ালা বর্ণনা করতেন, আমি শুনতাম এবং স্মরণ রাখতাম। দ্বিতীয় দিন তিনি পূর্বের মাসআলাগুলো আবার বলতেন, তা শুনে বুঝতে পারতাম আমি ঠিকই মুখস্থ করেছি। তার অন্যান্য শাগরিদ ভুল করত। ইমাম হাম্মাদ রহ. বলেন, আমার সামনে প্রথমে আবু হানিফা ছাড়া অন্য কেউ বসবে না। টানা দশ বছর; বরং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সাথে ছিলাম।
হাম্মাদ রহ.-এর এক সন্তান বর্ণনা করেন, একবার বাবা সফরে যান। তিনি ফিরে এলে জিজ্ঞাসা করি, সফরে সবচেয়ে বেশি কার কথা স্মরণ হয়েছে? আমি ধারণা করছিলাম, তিনি বলবেন, ‘তোমার’। কিন্তু তিনি আবু হানিফার নাম উল্লেখ করেন এবং বলেন, যদি সম্ভব হতো এক পলকের জন্যও আবু হানিফাকে আলাদা করতাম না।
ইলমের উৎস:
আমিরুল মুমিনিন আবু জাফর ইমাম আবু হানিফা রহ. কে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কোন কোন সাহাবির ইলম অর্জন করেছেন? তিনি বলেন, হযরত উমর ইবনে খাত্তাব, আলী ইবনে আবু তালেব, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এবং তাদের শিষ্যদের। আবু জাফর বলেন, আপনি তো সঠিক ইলম অর্জন করেছেন। তারা অনেক বড় ব্যক্তি ছিলেন। উমর রা.-এর মর্যাদা তো স্বয়! রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, ‘আমার পরে কেউ নবী হলে উমর হতো।’ আলি রা.-কে নিজ হাতে কাজি বানিয়ে প্রেরণ করেছিলেন। অন্যদিকে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর কুরআনি ইলম তো উম্মতের মধ্যে প্রবাদতুল্য।
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর উসুল ও আকিদা
ইয়াহইয়া ইবনে জুরাইস বলেন: ‘আমি সুফিয়ানের কাছে উপস্থিত ছিলাম। এক লোক এসে তাকে বলে, ইমাম সাহেবের উপর আপনার কীসের আপত্তি? তিনি সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন: আপত্তি আবার কীসের? আমি নিজে তাকে বলতে শুনেছি, ‘আমি সর্বপ্রথম কুরআন গ্রহণ করি। কোনো মাসয়ালা তাতে না পেলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতে অনুসন্ধান করি। কুরআন-হাদিস কোনোটাতেই না পেলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিদের বক্তব্যের মধ্যে খুঁজি; এক্ষেত্রে যার বক্তব্য বেশি পছন্দ হয়, সেটা গ্রহণ করি। কিন্তু তাদের বক্তব্যের বাইরে যাই না। হ্যাঁ, তাবেয়িদের আনুগত্য করা আবশ্যক মনে করি না। তারা যেভাবে ইজতিহাদ করেছেন, আমিও সেভাবেই ইজতিহাদ করি।’
ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, ইমাম আবু হানিফা রহ. বলতেন: ‘খোরাসানের দুই ধরনের লোক সবচেয়ে নিকৃষ্ট। তারা হলো: জাহামিয়া ও মুশাব্বিহা।
ইয়াহইয়া ইবনে নাসর বলেন: ‘আবু হানিফা রহ. আবু বকর ও উমর ইবনে খাত্তাব রা.-কে অন্যান্য সাহাবীদের উপর প্রাধান্য দিতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই জামাতা উসমান ও আলি রা.-কে মহব্বত করতেন। তাকদিরে বিশ্বাস করতেন, সেক্ষেত্রে কোনো ছিদ্রান্বেষণ করতেন না। মোজার উপর মাসাহ করতেন। সমকালীন সবচেয়ে বড় ও মুত্তাকি আলেম ছিলেন। ‘
আবু সুলাইমান জাওযাজানি ও মুতি ইবনে মানসুর বলেন: ‘ইমাম আবু হানিফা ও তার শিষ্যদের মধ্যে কেউ কুরআন মাখলুক হওয়ার ব্যাপারে কথা বলেননি। হ্যাঁ, বিশর মুরাইসি ও ইবনে আবু দাউদ এ মাসআলায় কথা বলা শুরু করেছিল এবং তারাই ইমাম সাহেবের শিষ্যদের বদনাম করেছে।’
বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম আবু দাউদ রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা মালেকের উপর রহমত বর্ষণ করুন, তিনি তার সময়ের শ্রেষ্ঠ ইমাম ছিলেন। শাফেয়ীর উপর রহমত বর্ষণ করুন, তিনি নিজ সময়ে ইমাম ছিলেন। আবু হানিফার উপর রহমত বর্ষণ করুন, সমকালীন ইমাম ছিলেন। ‘
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর উপর অমানবিক বেত্রাঘাত ও বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ না করার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদে ফেলতেন এবং ইমাম সাহেব রহ.-এর জন্য রহমতের দোয়া করতেন।
আলি ইবনে মাদিনী রহ. (ইমাম বুখারীর উস্তাদ) বলেন, ‘ইমাম সাহেব থেকে সাওরি, ইবনে মোবারক, হাম্মাদ ইবনে জায়েদ, হুশাইম, ওয়াকি, আব্বাদ, জাফর ইবনে আওনের মতো মুহাদ্দিসগণ হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি নির্ভরযোগ্য। তার বর্ণনায় কোনো দুর্বলতা নেই।’
ইয়াহইয়া ইবনে মাইন রহ. কে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আবু জাকারিয়া! (তার উপনাম) আবু হানিফার হাদিস কি সত্য মনে করা হতো? তিনি বলেন: তিনি অত্যন্ত সত্য ও সঠিক বর্ণনা করতেন। একবার তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আবু হানিফা কি কখনো বাস্তবতার বিপরীতও হাদিস বর্ণনা করেছেন? তিনি বলেন, মুহাদ্দিসগণ আবু হানিফা ও তার ছাত্রদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে, তাদের অবস্থান ছিল অনেক ঊর্ধ্বে।’
ফিকহে হানাফির অনন্যতা:
হানাফি ফিকহ কোনো একক ব্যক্তির অভিমতের উপর প্রতিষ্ঠ নয়; বরং তা চল্লিশজন মুজতাহিদ আলেমের পরামর্শক্রমে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ইমাম তহাবি রহ, সনদের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন, ইমাম সাহেবের পরামর্শ মজলিসে চল্লিশজন সদস্য ছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবু ইউসুফ, যুফার ইবনে হুজাইল, দাউদ আত-তায়ি, আসাদ ইবনে আমর, ইউসুফ ইবনে খালেদ আস-সামতি (তিনি ইমাম শাফেয়ি রহ.-এর উস্তাদ ছিলেন), ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া ইবনে আবু জায়েদা। খতিবে বাগদাদি ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর আলোচনা করতে গিয়ে আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন। আফিয়া আজদি, কাসেম ইবনে মা’ন, আলি ইবনে মাহর, হিব্বান ও মিনদাল।
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর সামনে একটি মাসয়ালার ভিন্ন ভিন্ন সমাধান পেশ করা হলে তিনি সবচেয়ে বিশ্লেষণধর্মী জবাবটি দিতেন। এভাবেই একেকটি মাসআলা নিয়ে তিন দিন পর্যন্ত আলোচনা চলতে থাকত। কোনো কোনো মাসয়ালার ক্ষেত্রে মাস ব্যাপী আলোচনা-পর্যালোচনা অব্যাহত থাকত। এরপর তা লিপিবদ্ধ করা হতো।
সাইমারি বর্ণনা করেন, শিষ্যগণ ইমাম সাহেবের সাথে মাসয়ালা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করতে থাকতেন। সে সময় কাজি আফিয়া ইবনে ইয়াজিদ উপস্থিত না থাকলে ইমাম সাহেব বলতেন, মাসয়ালার ফায়সালা মুলতুবি রাখো। যখন তিনি আগমন করতেন এবং মাসয়ালার ক্ষেত্রেও একমত পোষণ করতেন। এবার ইমাম সাহেব রহ. বলতেন, এবার মাসয়ালাটি লিখে নাও। আলোচনা-পর্যালোচনার এ ধাপগুলো পার না করলে তিনি কোনো মাসয়ালা লিখতে দিতেন না।
ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন, ‘যে ইলমে ফিকহ অর্জন করতে চায়, সে যেন ইমাম। আবু হানিফা ও তার ছাত্রদের পিছু না ছাড়ে; কেননা ফিকহের ক্ষেত্রে সকলেই তাদের মুখাপেক্ষী।’
ইমাম বুখারী রহ.-এর উস্তাদ মাক্কি ইবনে ইবরাহিম ইমাম আবু হানিফা রহ.- এর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘তিনি সমকালীন সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন।’
প্রসিদ্ধ ফকিহ আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক রহ. বলেন, ‘আমি শামে ইমাম আওজায়ী রহ.- এর কাছে গমন করি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, হে খোরাসানী! কুফাতে এ কেমন বিদয়াতি জন্মগ্রহণ নিয়েছে, যার উপনাম আবু হানিফা? এ কথা শুনে আমি ঘরে ফিরে আসি। তিন দিন ব্যয় করে ইমাম সাহেবের বিশেষ বিশেষ মাসয়ালাগুলো একত্রিত করে তৃতীয় দিন নিজ হাতে কিতাব নিয়ে ফিরে আসি। তিনি ইমাম আওজায়ী মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন ছিলেন। জিজ্ঞাসা করেন, এটা কী কিতাব? আমি কিতাব দিয়ে দিই।
তিনি কিতাবে ওই মাসয়ালাটিও দেখতে পান, যার শুরুতে আমি লিখে দিয়েছিলাম, ‘আর নুমান তার ব্যাপারে এ কথা বলেন।’ আজান দেওয়ার পর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিতাবের শুরুর কিছু অংশ দেখতে থাকেন। অতঃপর কিতাবটি আস্তিনের নিচে রেখে ইকামত বলে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে কিতাব বের করে আবার পড়া শুরু করেন এবং শেষ করেন। পড়া শেষে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, হে খোরাসানি! নুমান লোকটা কে? আমি বলি, একজন শাইখ। ইরাকে তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি বলেন, সে তো অনেক বড় মাপের শাইখ। যাও! তার থেকে আরও ইলম শেখো। এরপর আমি বলি, উনিই তো সেই আবু হানিফা, আপনি আমাকে যার কাছেও যেতে নিষেধ করেছিলেন।’
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর কারাবরণ ও মৃত্যু:
তৎকালীন খলিফা মানসুর ইমাম আবু হানিফা রহ. কে প্রধান বিচারক বানাতে চাইলে তিনি এই বলে অস্বীকার করেন। ফলে খলিফা মানসুর রাগান্বিত হয়ে ইমাম সাহেবকে কারাগারে আবদ্ধ করে। পরবর্তীতে বিষপ্রয়োগে ইমাম আবু হানিফা রহ. কে শহীদ ককরে দেওয়া হয়। তিনি ১৫০ হিজরী মোতাবেক ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেন। তার জানাজায় বহু লোকের সমাগম হয়। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমীন।