আবু বকর সিদ্দিক রা. শাসনকালের সোয়া দুই বছর অতিবাহিত করেন, এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নবুওয়াত দাবিদার, মুরতাদ, বিদ্রোহী ও জাকাত অস্বীকারকারীদের দমন করে বিজয়ের যাত্রা শুরু করেছিলেন; এরই মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করে প্রিয় হাবিবের ডাক সাড়া দেন ।
আবু বকর রা.-এর মৃত্যু
আয়েশা রা. বলেন: এক প্রচণ্ড শীতের দিন তিনি গোসল করেন । গোসলের পর তার শরীরে জ্বর চলে আসে। ১৫ দিন তিনি প্রচণ্ড জ্বরে ভুগতে থাকেন। শরীরের সক্ষমতা কমতে থাকে। এমনকি এক পর্যায়ে তিনি মসজিদে গমনে অক্ষম হয়ে পড়েন । তার নির্দেশে উমর রা. ইমামতির দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
রোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে তিনি সুস্থতার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েন, তখন সাহাবায়ে কেরামদের ডেকে তার স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের পরামর্শ চান। আবু বকর রা. নিজে উমর রা.-কে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করার ব্যপারে মতামত প্রদান করেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. বলেন: উমর এ দায়িত্বের উপযুক্ত ব্যক্তি হওয়ার ব্যাপারে কারও সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে তিনি কিছুটা কঠোর প্রকৃতির।
উসমান রা. বলেন: আমার মতে উমরের ভেতরগত অবস্থা বাইরের চেয়েও উত্তম। তবে কতিপয় সাহাবি উমর রা.-এর কঠোরতার কারণে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তালহা রা. তাকে দেখতে এসে অভিযোগ করেন, আপনি উমরকে খলিফা বানাতে চাচ্ছেন, তিনি আপনার সামনেই কতটা কঠোর ছিলেন তা তো নিজেই দেখেছেন। আল্লাহ ভালো জানেন সামনে তিনি কী করেন?
আবু বকর সিদ্দিক রা. বলেন, খেলাফতের দায়িত্ব কাঁধে অর্পিত হলে আপনা থেকেই নরম হয়ে যাবেন। অনুরূপ আরেক সাহাবি বলেন, আপনি উমরের কঠোরতা ব্যাপারে অবগত হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে তাকে স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করছেন? একটু চিন্তা-ভাবনা করে নিন । আপনি আল্লাহর দরবারে যাচ্ছেন, সেখানে কী জবাব দেবেন? আবু বকর রা. বলেন, ‘আমি বলব, হে আল্লাহ! আপনার বান্দাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বোত্তম, আমি তাকেই নির্বাচন করে এসেছি।’
মোটকথা, তিনি সবার সাথে পরামর্শ করে উসমান রা.-কে ডেকে খেলাফতের অঙ্গীকারনামা লেখানো শুরু করেন। শুরুর কিছু অংশ লেখার পর আবু বকর রা. জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। উসমান রা. এ অবস্থা দেখে নিজের পক্ষ থেকেই উমর রা.-এর নাম লিপিবদ্ধ করে দেন।
কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আসলে উসমান রা.-কে বলেন যা লিখেছ তা পড়ে শোনাও। উসমান রা. পড়া শেষ করলে তিনি অকপটে বলে উঠেন: ‘আল্লাহু আকবার! আল্লাহ তায়ালা তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন। তুমি আমার অন্তরের কথাই লিখে দিয়েছ।’
অঙ্গীকারনামা লিপিবদ্ধ হলে তিনি আপন গোলামকে তা জনসম্মুখে পড়ে শোনাতে বলেন। এরপর তিনি উপস্থিত লোকদের বলেন: আমি আমার নিকটাত্মীয় কিংবা ভাইকে খলিফা নির্ধারণ করিনি; বরং তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিকেই করেছি। উপস্থিত সকলেই তার এই নির্বাচনকে মেনে নেয়। তিনি উমর রা.-কে ডেকে গুরুত্বপূর্ণ নসিহত করেন। যা তার সফল খেলাফত পরিচালনায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্ব পালন শেষে আবু বকর সিদ্দিক রা. ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়াদির প্রতি মনোনিবেশ করেন।
তিনি আয়েশা সিদ্দিকা রা.-কে মদিনায় একটি জায়গার মালিকানা দিয়েছিলে; তার মনে হয়, এর ফলে অন্য সন্তানদের অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে। তাই আয়েশা রা.-কে লক্ষ্য করে বলেন, মা! দারিদ্র্য ও ধনাঢ্য উভয় অবস্থায় তুমি ছিলে আমার সবচেয়ে প্রিয়তম। আমি তোমাকে যে জায়গা দিয়েছি, তুমি কি এতে তোমার ভাই-বোনদের শরিক করে নেবে? আয়েশা রা. ইতিবাচক উত্তর দিলে আবু বকর রা. বাইতুল মালের ঋণ আদায়ের ওসিয়ত করে বলেন, আমার কাছে একটি বাঁদি এবং দুটি উট ছাড়া মুসলমানদের অন্য কোনো সম্পদ নেই। আমার ইন্তেকালের পরপরই এগুলো (পরবর্তী খলীফা) উমরের কাছে পাঠিয়ে দেবে। আবু বকর রা.-এর ইন্তেকালের পর ওসিয়ত অনুযায়ী এগুলো উমর রা.-এর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন, আবু বকর রা. এ কথাও বলেছিলেন: আমার কাফন-দাফনের পর অতিরিক্ত কিছু থাকলে সেগুলোও তোমরা উমরের কাছে পাঠিয়ে দেবে। সে অনুযায়ী তার ঘরের আসবাবপত্রের খোঁজ নেওয়া হলে সেখানে কিছুই পাওয়া যায়নি।
কাফনের ব্যাপারে আবু বকর রা.-এর ওসিয়ত ছিল: এখন শরীরে যে কাপড় রয়েছে তা ধুয়ে অন্য কাপড়ের সঙ্গে কাফন দেবে। আয়েশা রা. বলেছিলেন এগুলো তো পুরোনো কাপড়। কাফনের জন্য নতুন কাপড় হওয়া দরকার। আবু বকর রা. বলেন, মৃতদের তুলনায় জীবিতরাই নতুন কাপড়ের বেশি হকদার। আমার জন্য এই পুরোনো জীর্ণ শীর্ণ কাপড়ই যথেষ্ট।
এরপর তিনি জিজ্ঞেস করেন, আজ কী বার? বলা হয়, সোমবার। পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, নবীজি কোন দিন ইন্তেকাল করেছিলেন? বলা হয়, সোমবারে। তিনি বলেন, আহ! আল্লাহ যদি আজ আমাকে উঠিয়ে নিতেন! তার এই সর্বশেষ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় । তিনি সোমবার দিন শেষে মঙ্গলবার রাতে ৬৩ বছর বয়সে ১৩ হিজরিতে জুমাদাল উলা মাসে ইহকাল ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন
ওসিয়ত অনুযায়ী রাতেই তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। উমর রা. তার জানাজার নামাজ পড়ান। উসমান রা., তালহা রা., আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রা. ও উমর রা. তার কবরে অবতরণ করেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশেই সমাহিত হন ।