খলিফাতুল রাসুল হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে (৫১ হিজরি পূর্ব) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাসুল সা.-এর বিশ্বস্ত সঙ্গী, সাহাবী এবং ইসলামের প্রথম খলিফা। রাসুল সা.-এর পর তিনি খেলাফতের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন।
নাম ও বংশ:
নাম: আবদুল্লাহ। উপনাম: আবু বকর। উপাধি: সিদ্দিক ও আতিক। পিতার নাম: উসমান। পিতার উপনাম: আবু কুহাফা। মায়ের নাম: সালমা। উপনাম: উম্মুল খায়ের।
পিতার দিক থেকে বংশীয় সনদ হলো: আবদুল্লাহ ইবনে উসমান ইবনে আমের ইবনে আমর ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তাইম ইবনে মুররা ইবনে কাব ইবনে লুয়াই আল-কুরাশি আত-তামিমি। মায়ের দিকের বংশীয় সনদ হলো: উম্মুল খায়ের বিনতে সাখার ইবনে আমের ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তাইম ইবনে মুররা। এভাবে ষষ্ঠ পুরুষে গিয়ে আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর বংশ, রাসুল সা.-এর বংশ তালিকার সঙ্গে মিলে যায়।
শারীরিক গঠন:
আবু বকর রা. ছিলেন অতি শীর্ণকায়। চেহারা ছিল হালকা-পাতলা। গাত্রবর্ণ ছিল বাদামি। তিনি উঁচু ও প্রশস্ত কপালের অধিকারী ছিলেন। চুলে মেহেদির খেজাব ব্যবহার করতেন।
স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি:
আবু বকর রা. একাধিক বিয়ে করেন। স্ত্রীগণ হলেন:
১. কুতাইলা বিনতে আবদুল উজ্জা রা.। তার গর্ভে আবদুল্লাহ রা. ও আসমা রা. জন্মগ্রহণ করেন।
২. উম্মে রোমান রা.। তার গর্ভে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. ও আবদুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন।
৩. আসমা রা.। তার ঘরে মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর রা. জন্মগ্রহণ করেছেন।
৪. হাবিবা বিনতে খারিজা রা.। তার গর্ভে আবু বকর রা.-এর সবচেয়ে ছোট কন্যা উম্মে কুলসুম রা. জন্মলাভ করেন।
ইসলামপূর্ব জীবন:
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আবু বকর রা. একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। তার সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার সুখ্যাতি ছিল পুরো মক্কাজুড়ে। প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও সদাচারের দরুন মক্কাবাসী তাকে খুব সম্মান ও ভক্তি-শ্রদ্ধা করত । তিনি ইসলামি যুগে যেমন মদপানকে ঘৃণা করতেন। মদ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মদপানে মানুষের সম্ভ্রমের ক্ষতি রয়েছে।
আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর ইসলাম গ্রহণ:
নবুওয়াত লাভের পর যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকটস্থদের মাঝে গোপনে ইসলামের কথা প্রচার করতে থাকেন। আবু বকর রা. কে নবুওয়াত লাভের বিষয়টি ব্যক্ত করলে তিনি সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। পুরুষদের মধ্যে আবু বকর রা.-ই সর্বপ্রথম ইসলামের সুশীতল ছায়ার আশ্রয় নেন।
পরবর্তীতে আবু বকর রা.-এর দাওয়াতে হযরত উসমান ইবনে আফফান রা., জুবায়ের ইবনে আওয়াম রা., আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা., সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা., তালহা ইবনে আবদুল্লাহ, উসমান ইবনে মাজউন, আবু উবায়দা, আবু সালামা ও খালেদ ইবনে সা’দ ইবনে আস রা. ইসলাম গ্রহণ করেন।
আবু বকর রা. নিজ ঘরের আঙিনায় ছোট্ট একটি মসজিদ বানিয়ে নেন। সেখানে তিনি ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী। কুরআন তেলাওয়াত কালে তার চোখ থেকে অশ্রুধারা বইত।
গাজওয়ায় অংশগ্রহণ:
মদিনার জীবনে মুসলমানদের অসহায়ত্বের অবসান ঘটে। কুরাইশরা গোপনে মুসলিম নিধনের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। মক্কা বিজয় পর্যন্ত রক্তাক্ত তাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। সকল যুদ্ধেই আবু বকর রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন পরামর্শদাতা ও সঙ্গী হিসেবে সাথে থাকতেন।
হজের নেতৃত্ব প্রদান:
নবম হিজরীতে নবীজি সা. আবু বকর রা.-কে হজের আমির বানিয়ে মক্কায় প্রেরণ করেন। বলে দেন, তিনি যেন মিনার ঘোষণা দেন—আগামী বছর যেন কোনো মুশরিক হজ করতে না আসে। কোনো উলঙ্গ ব্যক্তি যাতে কাবা শরিফ তাওয়াফ না করে। এই সময়ে সুরা তওবা অবতীর্ণ হয়। সুরাটি মানুষকে শোনানোর জন্য আলি রা.-কে পাঠানো হয়।
আবু বকর রা.-এর খেলাফত:
দশম হিজরিতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের জন্য মক্কা গমন করেন। এ সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দীর্ঘ খুতবা দেন। একপর্যায়ে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এক ব্যক্তিকে ইহকাল ও পরকালের মধ্যে একটি গ্রহণের অধিকার দিলে সে ইহকালের উপর পরকালকে প্রাধান্য দিয়েছে।’ আবু বকর রা. কথাটি শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। লোকজন বিস্মিত হয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। আবু বকর সিদ্দিক রা. বুঝতে পেরেছিলেন, লোকটি দ্বারা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই উদ্দেশ্য।
১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার নবীজি সা. ইন্তেকাল করেন। এ পরিস্থিতিতে মসজিদের দরজায় তখন এক ধরনের হট্টগোল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তিনি কাউকে কোনো কিছু না বলে সোজা আয়েশা রা.-এর ঘরে প্রবেশ করেন। রাসুলুল্লাহ সা.-এর চেহারা থেকে পর্দা উঠিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলেন,
بأبي أنت يا نبي الله لا يجمع الله عليك موتتين أما الموتة التي كتبت عليك
فقد ذقتها ثم لن تصيبك بعده موتة ابدا
“হে আল্লাহর নবী! আমার মাতাপিতা আপনার উপর কুরবান হোক। আল্লাহ আপনাকে দুটি মৃত্যু দান করবেন না। আপনার তাকদিরে যে মৃত্যু লেখা ছিল সেটা তো হয়ে গেছে, এরপর আপনি আর মৃত্যুবরণ করবেন না।”
এরপর চেহারা মোবারক চাদর দিয়ে ঢেকে কামরা থেকে বেরিয়ে আসেন। সিদ্দিক রা. দাঁড়িয়ে লোকদের সম্বোধন করা শুরু করে বলেন:
أما بعد فمن كان منكم يعبد محمدا فإن محمدا قد مات ومن كان منكم يعبد الله فإن الله حي لا يموت فإن الله قال: (وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ)
‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের ইবাদত করত, সে জেনে রাখুক, মুহাম্মাদ ইন্তেকাল করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করত, সে জেনে রাখুক, আল্লাহ তায়ালা চিরঞ্জীব, তিনি কখনও মৃত্যুবরণ করেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল, তার আগেও বহু রাসুল অতিবাহিত হয়েছেন, যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন কিংবা নিহত হন, তাহলে কি তোমরা উলটো দিকে চলবে?’
বক্তব্যটি ছিল এতই হৃদয়গ্রাহী যে, তা শুনে সকলেই প্রশান্তচিত্ত হয়ে ওঠেন। পঠিত আয়াত পরিস্থিতির অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমাদের মনে হচ্ছিল, যেন এই আয়াত ইতিপূর্বে অবতীর্ণই হয়নি।
খেলাফতের আসনে আবু বকর রা.
নবীজির ইন্তেকালের পরে মদিনায় খেলাফত নিয়ে আলোচনার উদ্ভূত হয়। আনসাররা সাকিফায়ে বনু সায়েদায় একত্রিত হয়ে খেলাফত নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। আবু বকর রা. ও উমর রা. যথাসময়ে বিষয়টি জানতে পেরে সেখানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। আবু বকর রা. উমর রা.-কে সঙ্গে নিয়ে সাকিফায়ে বনু সায়েদায় পৌঁছেন।
আনসারগণ দাবি করেন, একজন আমির হবেন আমাদের (আনসারদের) মধ্য থেকে, একজন হবেন তোমাদের (মুহাজিরদের) মধ্য থেকে। তবে, এর পরিণাম ছিল ভয়ংকর। আবু বকর রা. রাসুল সা.-এর বানী সামনে রেখে বক্তব্য দেন এবং মুহাজিরদের মধ্য থেকে খলিফা হওয়ার যৌক্তিক দলিল উপস্থাপন করে বলেন, মুহাজিরদের মধ্য থেকেই আমির নির্বাচিত হবে, আর আনসারদের মধ্য থেকে উজির হবে। তিনি আরও বলেন: এখানে আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ ও উমর ইবনে খাত্তাব উপস্থিত আছেন । আপনারা এ দুজনের যে কারও হাতে বাইয়াত হয়ে যান ।
উমর রা. তখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আবু বকর রা.-এর হাত টেনে নিয়ে বলেন, এটা হতে পারে না; আমরা আপনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করব । আপনিই আমাদের নেতা। আল্লাহর রাসুল আপনাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।
আসলেও তখন আবু বকর রা.-এর চেয়ে মর্যাদাবান কেউ ছিলেন না। তাই উমর রা.-এর নির্বাচনকে সকলেই প্রশংসার সঙ্গে গ্রহণ করে নেন। সমাবেশের সকলেই তার হাতে বাইয়াত হয়ে যায়। এরপর সবাই নবীজির কাফন-দাফন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
মৃত্যু: আবু বকর রা. ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তিনি হযরত উমর রা. কে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর। রাসুল সা.-এর কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়।